ইসলামের তৃতীয় খলিফা: উসমান ইবন আফফান (রা.)
ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে খিলাফতের যুগ একটি স্বর্ণালি অধ্যায়। রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর ইন্তেকালের পর মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন চারজন খলিফা, যাদেরকে খুলাফায়ে রাশেদিন বলা হয়। এদের মধ্যে তৃতীয় খলিফা ছিলেন উসমান ইবন আফফান (রা.), যিনি ইসলামের বিস্তার, কুরআনের সংরক্ষণ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর জীবনী শুধু মুসলিম ইতিহাসের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণার উৎস।
প্রাথমিক জীবন
উসমান ইবন আফফান (রা.) ৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু উমাইয়া শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন আফফান ইবন আবুল আস এবং মাতা ছিলেন আরওয়া বিনতে কুরাইয। বংশপরিচয় ও চরিত্রের জন্য তিনি সমাজে সম্মানিত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নম্রতা, লাজুকতা এবং সৎ স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন।
উসমান (রা.) বাণিজ্যে অত্যন্ত সফল ছিলেন। ধনী হয়েও তিনি কখনো অহংকারী হননি। ইসলাম গ্রহণের আগে থেকেই তিনি মদপান, জুয়া বা অন্যায় কাজে জড়িত ছিলেন না, যা সেই সময়কার আরব সমাজে বিরল গুণ ছিল।
ইসলাম গ্রহণ
রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর দাওয়াত পাওয়ার পর উসমান (রা.) ছিলেন প্রথমদিকের মুসলিমদের একজন। আবু বকর (রা.)-এর আহ্বানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এ কারণে তাঁর পরিবার প্রথমে ক্ষুব্ধ হয়েছিল, কিন্তু উসমান (রা.) তাঁর ঈমানের ব্যাপারে দৃঢ় ছিলেন। ইসলামের পথে তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। মক্কায় মুসলিমদের ওপর যখন অত্যাচার শুরু হয়, তিনি প্রথম হিজরতে ইথিওপিয়া গমন করেন, পরে মদিনায় হিজরত করেন।
রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সম্পর্ক
উসমান (রা.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জামাতা। প্রথমে তিনি নবীর কন্যা রুকাইয়া (রা.)-কে বিয়ে করেন। রুকাইয়া (রা.) ইন্তেকাল করলে নবী ﷺ তাঁর আরেক কন্যা উম্মে কুলসুম (রা.)-কে উসমান (রা.)-এর সাথে বিয়ে দেন। এজন্য তিনি "যুন-নুরাইন" (দুই নূরের অধিকারী) উপাধি পান।
খিলাফতে অধিষ্ঠান
দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবন খাত্তাব (রা.) মৃত্যুর আগে একটি শূরা কমিটি গঠন করেন, যার মাধ্যমে পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হন। সেই শূরা কমিটির মাধ্যমে ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে উসমান ইবন আফফান (রা.) ইসলামের তৃতীয় খলিফা নিযুক্ত হন।
শাসনামল ও প্রশাসনিক কাজ
উসমান (রা.)-এর শাসনকাল ছিল প্রায় ১২ বছর (৬৪৪–৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর শাসনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—
-
প্রথম ছয় বছর: শান্তি, উন্নতি এবং ইসলামের প্রসার
-
শেষ ছয় বছর: অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও রাজনৈতিক সংকট
গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমূহ:
-
কুরআনের সংরক্ষণ:
ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল কুরআনের একক মানক সংস্করণ প্রণয়ন। বিভিন্ন অঞ্চলে উচ্চারণ ও পাঠের ভিন্নতা দেখা দিলে উসমান (রা.) হযরত যায়েদ ইবন সাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন, যারা একটি মানক কপি প্রস্তুত করে। এরপর তিনি সেই কপিগুলো বিভিন্ন প্রদেশে পাঠিয়ে দেন এবং অন্যান্য ভিন্ন পাঠ ধ্বংসের নির্দেশ দেন। এর মাধ্যমে কুরআন আজ পর্যন্ত অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত আছে। -
সামরিক সম্প্রসারণ:
উসমান (রা.)-এর সময় ইসলামী সাম্রাজ্য উত্তর আফ্রিকা, পারস্য, তুরস্কের কিছু অংশ এবং মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত হয়। সমুদ্র পথে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। -
অর্থনৈতিক উন্নয়ন:
তিনি বাণিজ্যিক রুট উন্নত করেন, রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করান এবং সেচব্যবস্থা উন্নত করেন। তাঁর উদারতা ও দানশীলতা সুপরিচিত ছিল। নবীর জীবদ্দশায়ই তিনি তাবুক যুদ্ধের জন্য বিপুল সম্পদ দান করেছিলেন। -
প্রশাসনিক কাঠামো:
উসমান (রা.) উমর (রা.)-এর নীতি অনুসরণ করে প্রদেশসমূহে গভর্নর নিয়োগ দেন। যদিও শেষদিকে কিছু গভর্নরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে, তবুও তাঁর প্রশাসনিক সংস্কার ইসলামী রাষ্ট্রকে আরও সুসংগঠিত করেছিল।
অস্থিরতা ও বিরোধ
উসমান (রা.)-এর শেষ ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বাড়তে থাকে। কিছু গভর্নরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, বংশপ্রীতি (নেপোটিজম) ও কিছু রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝি বিদ্রোহের জন্ম দেয়। মিসর, কুফা ও বসরার কিছু বিদ্রোহী মদিনায় এসে অবরোধ সৃষ্টি করে। দীর্ঘ অবরোধ শেষে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে শহীদ করা হয়। তিনি শহীদ হওয়ার সময় কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন।
ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র
উসমান (রা.) ছিলেন অত্যন্ত লাজুক, নরম স্বভাবের এবং দানশীল। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
"উসমানের মতো লজ্জাশীল ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে আর কেউ নেই।"
তিনি সবসময় সরল জীবনযাপন করতেন, অথচ তাঁর সম্পদ ছিল বিপুল। তিনি দরিদ্র, এতিম ও বিধবাদের জন্য বিপুল পরিমাণে দান করতেন।
উত্তরাধিকার
উসমান (রা.)-এর শাসনকালে ইসলামের ভূখণ্ডের ব্যাপক বিস্তার, কুরআনের মানকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে মুসলিম উম্মাহকে উপকৃত করেছে। যদিও তাঁর শাহাদাতের পর মুসলিম সমাজে গৃহযুদ্ধ (ফিতনা) শুরু হয়, তবুও তাঁর অবদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
উপসংহার
ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফফান (রা.) ছিলেন একজন মহান নেতা, যিনি জ্ঞান, দয়া, দানশীলতা এবং ঈমানের দৃঢ়তার উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও নেতৃত্ব প্রমাণ করে যে ক্ষমতা কেবল শাসন করার জন্য নয়, বরং ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।
Comments
Post a Comment