Skip to main content

##আলাস্কা কেন বিক্রি করা হয়েছিল?


আলাস্কা কেন বিক্রি করা হয়েছিল?

বিশ্ব ইতিহাসে আলাস্কার বিক্রি বা Alaska Purchase একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৮৬৭ সালে মাত্র ৭.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে রাশিয়া আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে। আজ যখন আমরা এই ঘটনাটির দিকে ফিরে তাকাই, তখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অসাধারণ কৌশলগত সাফল্য বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাশিয়া কেন আলাস্কা বিক্রি করেছিল, এবং যুক্তরাষ্ট্র কেন এটি কিনতে চেয়েছিল? এই নিবন্ধে আমরা সেই ইতিহাস, কারণ এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

রাশিয়ান আলাস্কার পটভূমি

আলাস্কার সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক শুরু হয় ১৮শ শতকে। ভিটাস বেয়ারিং (Vitus Bering) এবং অন্যান্য অভিযাত্রীরা যখন এই অঞ্চল আবিষ্কার করেন, তখন রাশিয়ান ব্যবসায়ীরা এখানে পশমের ব্যবসা শুরু করে। বিশেষ করে সি-অটার বা সমুদ্রের ভোঁদড়ের চামড়া চীনে ও ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল।

১৮শ ও ১৯শ শতকের প্রথম দিকে রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানি আলাস্কায় উপনিবেশ স্থাপন করে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আলাস্কা রাশিয়ার কাছে এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়—দূরত্ব, জনসংখ্যার অভাব, প্রতিরক্ষার দুর্বলতা এবং আর্থিক সমস্যার কারণে।

রাশিয়ার আলাস্কা বিক্রির কারণ

১. অর্থনৈতিক সংকট

১৮৫৩-১৮৫৬ সালের ক্রিমিয়ান যুদ্ধের পর রাশিয়া প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। যুদ্ধ খরচ মেটাতে তাদের নতুন আয়ের উৎস দরকার ছিল। আলাস্কার পশম ব্যবসা প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এই অঞ্চল আর লাভজনক ছিল না। তাই বিক্রি করে কিছু অর্থ উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া।

২. পশম বাণিজ্যের পতন

১৮শ শতকে সি-অটার শিকারের মাধ্যমে বিপুল মুনাফা হলেও ১৯শ শতকে অতিরিক্ত শিকার করার ফলে পশমের উৎস প্রায় শেষ হয়ে যায়। ফলে আলাস্কা রাশিয়ার জন্য এক অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

৩. প্রতিরক্ষার দুর্বলতা

ভূগোলগতভাবে আলাস্কা ছিল ব্রিটিশ কানাডার কাছাকাছি। যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ নৌবাহিনী সহজেই আলাস্কা দখল করতে পারত। রাশিয়ার জন্য এত দূরের অঞ্চল রক্ষা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই ভবিষ্যতে বিনা মূল্যে হারানোর চেয়ে বিক্রি করে দেওয়াটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত।

৪. কৌশলগত গুরুত্বহীনতা

রাশিয়ার দৃষ্টি তখন পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার অভ্যন্তরে কেন্দ্রীভূত ছিল। আলাস্কার মতো দূরবর্তী অঞ্চলের তুলনায় এসব অঞ্চল ছিল তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কেন যুক্তরাষ্ট্র আলাস্কা কিনতে চেয়েছিল?

১. ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি (Manifest Destiny)

যুক্তরাষ্ট্র তখন "Manifest Destiny" মতাদর্শে বিশ্বাস করত, অর্থাৎ সমগ্র উত্তর আমেরিকায় তাদের বিস্তার হওয়া অনিবার্য। আলাস্কা যদিও ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল, তবুও এটি মার্কিন সম্প্রসারণনীতির অংশ হিসেবেই দেখা হয়েছিল।

২. অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

তৎকালীন আমেরিকান নেতারা মনে করতেন আলাস্কায় প্রচুর অজানা সম্পদ রয়েছে। তারা মাছ, কাঠ, খনিজ ও খনির সম্ভাবনা দেখেছিলেন। পরবর্তীতে সোনার খনি, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের আবিষ্কার এই ধারণার যথার্থতা প্রমাণ করে।

৩. কৌশলগত গুরুত্ব

আলাস্কার অবস্থান ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে, যা এশিয়ার কাছে এক ধরনের প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করত। ভবিষ্যতে যুদ্ধ বা বাণিজ্যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় সুবিধা এনে দেবে—এমন ধারণা তাদের ছিল।

৪. রাশিয়ার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় রাশিয়া ইউনিয়নকে সমর্থন করেছিল। তাই আলাস্কা ক্রয় কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করল।

আলাস্কা ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তি

১৮৬৭ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম এইচ. সিউয়ার্ড (William H. Seward) এবং রাশিয়ান দূত এডুয়ার্ড দে স্টোকেল (Eduard de Stoeckl)-এর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তি হয়। দাম নির্ধারণ করা হয় ৭.২ মিলিয়ন ডলার—প্রতি একর মাত্র দুই সেন্ট।

১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে আলাস্কা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। তবে আলাস্কা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায় অনেক পরে, ১৯৫৯ সালে।

সেই সময়ের জনমত

আলাস্কা কেনা নিয়ে তখনকার মার্কিন জনমত ছিল প্রায় একতরফাভাবে নেতিবাচক। সংবাদপত্রগুলো এই ক্রয়কে "Seward’s Folly" বা "Seward’s Icebox" বলে ঠাট্টা করত। সাধারণ মানুষ মনে করত, বরফে ঢাকা নির্জন ভূখণ্ডে টাকা নষ্ট হয়েছে।

কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, সিউয়ার্ডের সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী। আলাস্কার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৌশলগত গুরুত্ব ভবিষ্যতে আমেরিকার অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষাকে বহুগুণে শক্তিশালী করে।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

১. রাশিয়ার জন্য

রাশিয়ার কাছে এটি ছিল অস্থায়ীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত। তারা অর্থ পেল এবং একটি দুর্বল অঞ্চল থেকে মুক্তি পেল। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি ছিল ক্ষতির—কারণ তারা হারাল তেল, গ্যাস, সোনা ও মৎস্যসম্পদে ভরপুর এক বিশাল ভূখণ্ড।

২. যুক্তরাষ্ট্রের জন্য

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল সবচেয়ে লাভজনক জমি ক্রয়ের উদাহরণ। আলাস্কার সম্পদ মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধের সময় আলাস্কার অবস্থান কৌশলগতভাবে অপরিসীম মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছে।

৩. আদিবাসীদের জন্য

আলাস্কার আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই বিক্রয়ের কোন অংশেই জড়িত ছিল না। হঠাৎ করেই তারা এক নতুন শাসকের অধীনে চলে যায়। এর ফলে তাদের জমি, সংস্কৃতি ও অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘটনা থেকে শিক্ষা

আলাস্কার বিক্রয় আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়:

  • সাময়িক অর্থনৈতিক সংকটে দূরদর্শী সম্পদকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে ক্ষতি হয়।

  • কৌশলগত ভূগোল কখনও কখনও খনিজ সম্পদের চেয়েও মূল্যবান।

  • জনমত ও ইতিহাসের বিচারে একটি সিদ্ধান্তের মূল্য সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে।

উপসংহার

আলাস্কা বিক্রির প্রধান কারণ ছিল রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট, প্রতিরক্ষা দুর্বলতা এবং কৌশলগত গুরুত্বহীনতা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল সম্প্রসারণ, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ কৌশলগত শক্তির উৎস।

যা একসময় "Seward’s Folly" নামে উপহাসের পাত্র হয়েছিল, সেটিই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কখনও কখনও সমগ্র জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।

✍️ আলাস্কার বিক্রির এই ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে সময়, কৌশল এবং ভবিষ্যতের প্রভাবের জটিল যোগফল।


Comments

Popular posts from this blog

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

#What were the reasons for the conflict between the French, Spanish, Portuguese and the East India Company in India and what war was fought with them?

  The Great Game in the East: Why European Powers Clashed in India SEO Keywords: East India Company, Carnatic Wars, Anglo-French rivalry, European colonization India, Battle of Plassey, Battle of Wandiwash, colonial conflicts India, European trade monopolies, decline of Mughal Empire, Indian history WordPress Categories: History, Colonialism, India, European Powers, Wars, Trade The 17th and 18th centuries witnessed a dramatic transformation in India, as the vast and wealthy subcontinent became a battleground for European colonial ambitions. What began as a pursuit of lucrative trade quickly escalated into intense rivalries, culminating in a series of devastating wars that fundamentally reshaped India's destiny. The French, Spanish, Portuguese, and the formidable English East India Company were the key players in this intricate and often brutal "Great Game in the East," driven by economic greed, political power, and a fierce desire for supremacy. The Lure of the East: A ...

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...