গান্ধীজি কে ছিলেন?
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি বিশ্বজুড়ে মহাত্মা গান্ধী বা গান্ধীজি নামে পরিচিত, ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অনন্য নেতা ও চিন্তাবিদ। তিনি ২ অক্টোবর ১৮৬৯ সালে গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। গান্ধীজি কেবল ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের পথপ্রদর্শকই ছিলেন না, বরং তাঁর অহিংসা (Ahimsa) ও সত্যাগ্রহ (Satyagraha) দর্শন সারা বিশ্বে মানুষের মন ও চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে।
এই প্রবন্ধে আমরা গান্ধীজির জীবন, সংগ্রাম, দর্শন, কীর্তি এবং তাঁর স্থায়ী উত্তরাধিকারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শৈশব ও প্রারম্ভিক জীবন
গান্ধীজি এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। তাঁর বাবা করমচাঁদ গান্ধী পোরবন্দর রাজ্যের একজন রাজনৈতিক কর্মচারী ছিলেন, আর মা পুতলিবাই ছিলেন গভীর ধর্মপ্রাণ। ছোটবেলায় গান্ধীজি ছিলেন লাজুক ও অন্তর্মুখী স্বভাবের, তবে নৈতিকতা ও সততার দিক থেকে তিনি দৃঢ় ছিলেন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি কস্তুরবা (কস্তুরবাই মাখনজি) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যা সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী একটি সাধারণ বিষয় ছিল।
১৮৮৮ সালে তিনি আইন পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান। লন্ডনের ইনার টেম্পল-এ তিনি ব্যারিস্টারি পড়াশোনা করেন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন এবং খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ও হিন্দুধর্মসহ নানা ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। ১৮৯১ সালে তিনি ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা
গান্ধীজির জীবনের মোড় ঘুরে যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৮৯৩ সালে একটি আইনজীবী সংস্থার কাজে তিনি সেখান যান এবং সেখানেই বর্ণবৈষম্যের শিকার হন। একবার বৈধ টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়—এই ঘটনাই তাঁর মনে গভীর দাগ কাটে।
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০ বছরেরও বেশি সময় কাটান এবং সেখানকার ভারতীয় সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু করেন। এখানেই তিনি সত্যাগ্রহ দর্শনের বিকাশ ঘটান—অন্যায়ের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ।
ভারতে প্রত্যাবর্তন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
১৯১৫ সালে গান্ধীজি স্থায়ীভাবে ভারতে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও গরিব মানুষের দুঃখ-কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন।
চম্পারণ ও খেদা আন্দোলন
চম্পারণ (বিহার) ও খেদা (গুজরাট) অঞ্চলে কৃষকরা নীল চাষে বাধ্য হচ্ছিলেন এবং শোষণের শিকার হচ্ছিলেন। গান্ধীজি তাঁদের আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং অহিংস উপায়ে কৃষকদের জন্য ন্যায়সঙ্গত সমাধান আদায় করে দেন।
অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০–১৯২২)
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞের (১৯১৯) প্রতিবাদে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। ব্রিটিশদের বিদ্যালয়, পণ্য, উপাধি ও চাকরি বর্জনের ডাক দেন। এই আন্দোলন সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। যদিও চৌরি-চৌরা ঘটনায় সহিংসতার কারণে তিনি আন্দোলন স্থগিত করেন, তবুও এটি স্বাধীনতা সংগ্রামে এক ঐতিহাসিক ধাপ ছিল।
লবণ সত্যাগ্রহ বা দান্ডি অভিযান (১৯৩০)
গান্ধীজির সবচেয়ে প্রতীকী আন্দোলনের একটি ছিল লবণ সত্যাগ্রহ। ব্রিটিশ সরকার সাধারণ লবণের উপরও কর আরোপ করেছিল। প্রতিবাদস্বরূপ গান্ধীজি ২৪০ মাইল হেঁটে সমুদ্রের দিকে যান এবং সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরি করেন। এই সাধারণ কিন্তু সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গান্ধীজি “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর স্লোগান ছিল—“করো বা মরো।” যদিও ব্রিটিশরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে, তবুও এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি দৃঢ় করে তোলে।
গান্ধীজির দর্শন
গান্ধীজির জীবন ও সংগ্রামের মূল ভিত্তি ছিল তাঁর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ।
-
অহিংসা (Ahimsa): গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন যে সহিংসতা দিয়ে কখনো স্থায়ী সমাধান আসতে পারে না। সত্যিকার পরিবর্তন সম্ভব কেবল ভালোবাসা, সহনশীলতা ও ক্ষমার মাধ্যমে।
-
সত্যাগ্রহ (Satyagraha): সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় থাকার দর্শন। অন্যায় আইন ভাঙতে হবে কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে।
-
সর্বোদয় (Sarvodaya): সবার কল্যাণ—তিনি চাইতেন ভারত শুধু স্বাধীন হোক না, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।
-
ধর্মীয় সহনশীলতা: গান্ধীজি সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি গীতা, কোরআন ও বাইবেলের শিক্ষা উদ্ধৃত করে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বার্তা দিতেন।
ব্যক্তিজীবন ও সরলতা
গান্ধীজি অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি খদ্দরের পোশাক পরতেন, গ্রামে বসবাস করতেন, নিরামিষভোজী ছিলেন এবং আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস পালন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একজন প্রকৃত নেতা হতে হলে আগে নিজেকে সাধারণ মানুষের মতো করে গড়ে তুলতে হয়।
সমালোচনা ও মতবিরোধ
যদিও গান্ধীজি বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধেয়, তবে তাঁকে ঘিরে সমালোচনাও ছিল। কেউ কেউ মনে করতেন তাঁর অহিংস নীতি স্বাধীনতার গতি ধীর করেছে। বিপ্লবী নেতা যেমন সুভাষচন্দ্র বসু ও ভগত সিং-এর মতবাদ ছিল অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। তাছাড়া তাঁর জাত-পাত বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিও সমালোচিত হয়েছিল।
মৃত্যু
ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পর, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, নাথুরাম গডসে নামক এক হিন্দু উগ্রপন্থী গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ব শোকাহত হয়।
গান্ধীজির উত্তরাধিকার ও প্রভাব
গান্ধীজি শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের জন্য প্রেরণার উৎস।
-
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে গান্ধীজির অহিংস দর্শন অনুসরণ করেন।
-
নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গান্ধীজির শিক্ষা কাজে লাগান।
-
জাতিসংঘ ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস ঘোষণা করেছে।
ভারতে তাঁকে “জাতির পিতা” বলা হয়, আর তাঁর ছবি আজও ভারতীয় মুদ্রায় অঙ্কিত।
উপসংহার
গান্ধীজি ছিলেন কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন; তিনি ছিলেন নৈতিক শক্তির প্রতীক। তাঁর দর্শন ও আদর্শ দেখিয়েছে যে অন্যায় ও দমনপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই জেতা সম্ভব অহিংস উপায়ে।
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—
“তুমি সেই পরিবর্তন হও, যা তুমি পৃথিবীতে দেখতে চাও।”
মহাত্মা গান্ধী তাই আজও শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।
Comments
Post a Comment