পাকিস্তানে কাওয়ালি সঙ্গীতের জনক: উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলি খান
কাওয়ালি—একটি আত্মা-জাগানিয়া সুফি সংগীত—যা শত শত বছর ধরে উপমহাদেশের মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে এসেছে। এ সংগীত শুধু সুর বা তাল নয়, এটি আধ্যাত্মিক এক সাধনার মাধ্যম। কাওয়ালির জন্ম যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে ১৩শ শতকে, তবে পাকিস্তানে কাওয়ালিকে আধুনিক রূপে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়েছেন একজন মহান শিল্পী—উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলি খান। পাকিস্তানে তাঁকেই ‘কাওয়ালির জনক’ (Father of Qawwali in Pakistan) হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই প্রবন্ধে আমরা দেখব কেন নুসরাত ফতেহ আলি খানকে পাকিস্তানের কাওয়ালি সংগীতের জনক বলা হয়, তাঁর অবদান, ও কিভাবে তিনি প্রাচীন এই সংগীতকে আধুনিক রূপে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছেন।
কাওয়ালির উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কাওয়ালির গোড়াপত্তন হয় দিল্লীর সুফি সাধক হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য আমীর খসরু-এর হাত ধরে। তিনি পারস্য, আরব, তুর্কি ও ভারতীয় সংগীতকে মিশিয়ে এক নতুন ধারার সুফি সংগীত সৃষ্টি করেন, যেটি পরিচিত হয় “কাওয়ালি” নামে। মূলত চিশতিয়া তরিকার সুফিরা এটি ধর্মপ্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন।
ভারত ভাগের পর পাকিস্তানে অনেক সুফি ঐতিহ্য স্থানান্তরিত হয়, এবং কাওয়ালি সেখানে এক গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ধারা হয়ে ওঠে।
নুসরাত ফতেহ আলি খানের জীবনের সূচনা
নুসরাত ফতেহ আলি খান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ১৩ অক্টোবর পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদ (তৎকালীন লায়লপুর) শহরে। তিনি ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী কাওয়াল পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা উস্তাদ ফতেহ আলি খান নিজেও একজন খ্যাতিমান কাওয়াল ছিলেন। পরিবারের প্রায় ৬০০ বছরের কাওয়ালি সাধনার ঐতিহ্য ছিল।
প্রথমদিকে তাঁর বাবা চাননি যে নুসরাত কাওয়ালি গানের পথে আসুক, কারণ এটি একাধারে কঠিন এবং আত্মত্যাগমূলক সাধনার কাজ। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তাঁর চাচা মোবারক আলি খান ও অন্যান্য গুরুদের কাছে তালিম নিয়ে নুসরাত এই পথে আসেন এবং খুব অল্প সময়েই অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
পাকিস্তানে কাওয়ালির রূপান্তর ও আধুনিকায়ন
১৯৭০-এর দশকে পাকিস্তানে কাওয়ালি সীমাবদ্ধ ছিল মাজার, দরগাহ বা ধর্মীয় সমাবেশে। কিন্তু নুসরাত ফতেহ আলি খান একে নিয়ে এলেন মূলস্রোতে। তিনি কাওয়ালিকে শুধুই ধর্মীয় সঙ্গীত না রেখে এক নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন, যেখানে ছিল সুরের সৌন্দর্য, গভীরতা এবং আধ্যাত্মিক উন্মাদনা।
🔹 ১. ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন
নুসরাত তাঁর গানে প্রথাগত কাওয়ালির ধারা বজায় রাখলেও যুক্ত করলেন নতুন বাদ্যযন্ত্র (সিনথেসাইজার, গিটার), নতুন উপস্থাপনভঙ্গি এবং কিছুটা ওয়েস্টার্ন ছোঁয়া। তবে তিনি কখনোই আধ্যাত্মিক মূল বক্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।
🔹 ২. আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন
১৯৮৫ সালে যুক্তরাজ্যের WOMAD (World of Music, Arts and Dance) ফেস্টিভ্যালে তাঁর পারফরম্যান্স তাঁকে বিশ্বপরিচিত করে তোলে। এরপর তিনি পিটার গ্যাব্রিয়েল, মাইকেল ব্রুক প্রমুখ পশ্চিমা সংগীতজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যায় Dead Man Walking, The Last Temptation of Christ প্রভৃতি সিনেমার সাউন্ডট্র্যাকে।
🔹 ৩. তারুণ্যের হৃদয়ে কাওয়ালির ঘর বাঁধা
যখন তরুণ প্রজন্ম পশ্চিমা সংগীত ও পপ কালচারের দিকে ঝুঁকছিল, তখন নুসরাত ফতেহ আলি খান তাঁদের কাছে কাওয়ালিকে নতুনভাবে তুলে ধরেন। “আল্লাহ হু”, “আফরিন আফরিন”, “তুমহেঁ দিল্লাগি” গানগুলো আজও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
নুসরাত ফতেহ আলি খানের কীর্তি ও প্রভাব
১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্ট, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নুসরাত ফতেহ আলি খান মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সংগীতের ভাণ্ডার আজও অম্লান। তাঁর প্রভাব অনেকভাবে পরিলক্ষিত হয়:
-
🎵 বিশ্বসংগীতে অবদান: জেফ বাকলি থেকে শুরু করে এ আর রহমান পর্যন্ত অনেক সংগীতজ্ঞ তাঁর কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
-
🎵 কোক স্টুডিওর পুনরুত্থান: পাকিস্তানের ‘Coke Studio’ প্রকল্প মূলত নুসরাতের কাওয়ালি ঘরানার আধুনিক রূপ। তাঁর ভাতিজা রাহাত ফতেহ আলি খান আজও তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে কাজ করছেন।
-
🎵 একাডেমিক স্বীকৃতি: যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সংগীত বিশ্লেষণ করে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
তাঁকেই কেন বলা হয় 'পাকিস্তানে কাওয়ালির জনক'?
উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলি খান কাওয়ালির আবিষ্কর্তা না হলেও, পাকিস্তানে কাওয়ালিকে আধুনিক রূপ দিয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। তাঁকেই “Father of Qawwali in Pakistan” বলা হয় নিম্নলিখিত কারণে:
-
পুনর্জাগরণ: তিনি কাওয়ালিকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন, যা সমাজে হারিয়ে যাচ্ছিল।
-
গণমানুষের কাছে পৌছানো: কাওয়ালিকে শুধু দরগাহ বা ধর্মীয় সীমার বাইরে এনে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেন।
-
আধুনিকীকরণ: কাওয়ালির গভীরতা অক্ষুণ্ণ রেখে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ও ধারা যুক্ত করেন।
-
আন্তর্জাতিকতা: তিনি কাওয়ালিকে পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক রপ্তানি করে তোলেন।
উপসংহার
কাওয়ালি শুধুমাত্র একটি সংগীতধারা নয়; এটি আত্মার সাথে স্রষ্টার সংযোগের এক মাধ্যম। নুসরাত ফতেহ আলি খান সেই সংযোগকে কণ্ঠের মাধ্যমে কোটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি শুধু একজন কাওয়াল ছিলেন না, ছিলেন এক আধ্যাত্মিক দূত।
এই কারণেই তাঁকেই বলা হয় পাকিস্তানে কাওয়ালি সংগীতের জনক—একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, যাঁর গানের ধারা আজও জীবন্ত, অনুপ্রেরণাদায়ক এবং বিশ্বজনীন।
Comments
Post a Comment