কোন আফগান সেনাপতি ভারত আক্রমণ করেছিলেন?
আহমদ শাহ আবদালি এবং তার আক্রমণসমূহের গল্প
ভারতের দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাসে বহু বিদেশি আক্রমণের ঘটনা রয়েছে। ১৮ শতকে আফগানিস্তান থেকে ভারতের অন্যতম শক্তিশালী আক্রমণকারী ছিলেন আহমদ শাহ আবদালি, যিনি পরে পরিচিত হন আহমদ শাহ দুররানি নামে এবং আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত হন। ভারতের উপর তার একাধিক আক্রমণ উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
কে ছিলেন আহমদ শাহ আবদালি?
আহমদ শাহ আবদালি (১৭২২–১৭৭২) আফগানিস্তানের হেরাতে আবদালি পশতু গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যের নাদির শাহ-এর সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে ছিলেন। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহ হত্যার পর তিনি কান্দাহারে ফিরে যান এবং উপজাতি প্রধানদের এক সভায় (লোয়া জিরগা) তাঁকে আফগানিস্তানের রাজা নির্বাচিত করা হয়। এভাবেই দুররানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তাঁর গোত্রও দুররানি নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর তিনি পূর্বদিকে, অর্থাৎ ভারতের দিকে নজর দেন।
কেন তিনি ভারত আক্রমণ করেছিলেন?
আহমদ শাহ আবদালি ভারতের উপর আক্রমণ করেন নিম্নলিখিত কারণে:
- অর্থনৈতিক: ভারতের সম্পদ আফগানিস্তানের তুলনায় বিপুল। তিনি তার সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য ধনসম্পদ এবং সৈন্যদের জন্য লুটের আশায় ভারতের দিকে অগ্রসর হন।
- রাজনৈতিক সুযোগ: ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে, বিভিন্ন প্রাদেশিক শক্তি — যেমন মারাঠা, শিখ, রোহিলা, ও নবাব — ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করতে থাকে।
- কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি: আবদালি চেয়েছিলেন পূর্ব সীমান্ত নিরাপদ রাখতে যাতে মারাঠা ও শিখদের আগ্রাসন থেকে কাবুল ও পাঞ্জাব রক্ষা করা যায়।
প্রধান আক্রমণসমূহ
আহমদ শাহ আবদালি ১৭৪৮ থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত মোট ৯ বার ভারত আক্রমণ করেন। তবে কয়েকটি আক্রমণ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আক্রমণ (১৭৪৮)
ক্ষমতা গ্রহণের পরই তিনি ১২,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে সিন্ধু নদ অতিক্রম করে পাঞ্জাবে প্রবেশ করেন। কিন্তু মুঘল সেনাপতি আহমদ শাহ ও সফদার জং তাঁকে মনুপুর যুদ্ধে পরাজিত করেন। এরপর তিনি পিছু হটে যান, কিন্তু পুনরায় আরও প্রস্তুত হয়ে ফিরে আসেন।
লাহোর ও পাঞ্জাব দখল (১৭৫১–৫২)
তিনি দুর্বল মুঘল শাসনের সুযোগ নিয়ে আবার আক্রমণ করেন এবং সহজেই লাহোর দখল করে নেন। মুঘল সম্রাট আহমদ শাহ বাহাদুর পাঞ্জাব হস্তান্তর করেন, যা দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।
দিল্লির লুণ্ঠন (১৭৫৬–৫৭)
১৭৫৬ সালে তিনি বড়সড় আক্রমণ চালান, দিল্লি ও মথুরা দখল করেন এবং বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ ও হাজার হাজার বন্দি নিয়ে আফগানিস্তানে ফিরে যান। এটি মুঘল রাজধানীর উপর মারাত্মক আঘাত ছিল।
পানিপতের তৃতীয় যুদ্ধ (১৭৬১)
এটি ছিল ভারতের উপর তার আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায় এবং ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
- মারাঠারা তখন ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং পাঞ্জাবের দিকে প্রসারিত হচ্ছিল।
- আবদালি রোহিলা ও আওধের শুজাউদ্দৌলার সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং মারাঠা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালান।
- ১৪ জানুয়ারি ১৭৬১ সালে পানিপতে (দিল্লির উত্তরে) এক ভয়াবহ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়—যেখানে অনুমান করা হয় ১ লক্ষের বেশি সৈন্য ও সাধারণ নাগরিক প্রাণ হারান।
যদিও আবদালি বিজয় লাভ করেন, তাঁর সেনাবাহিনী ক্লান্ত ছিল এবং তিনি ভারতে স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এই যুদ্ধে বিপুল প্রাণহানি এবং ক্ষমতার শূন্যতা ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল এবং ব্রিটিশরা সেই সুযোগ নেয়।
আক্রমণের পরিণাম
ভারতের জন্য
- মারাঠারা সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও, মাধবরাও প্রথমের নেতৃত্বে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে।
- শিখেরা পাঞ্জাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত মহারাজা রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
- মুঘলরা নামমাত্র শাসক হিসেবে থাকলেও, ব্রিটিশদের জন্য শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।
আফগানিস্তানের জন্য
আহমদ শাহ আবদালি বিপুল ধনসম্পদসহ আফগানিস্তানে ফিরে যান, কিন্তু একাধিক অভিযান তার সম্পদ ও শক্তিকে দুর্বল করে তোলে। ১৭৭২ সালে তার মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে শুরু করে।
আবদালির উত্তরাধিকার
আহমদ শাহ আবদালিকে আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তিনি “আহমদ শাহ বাবা” নামে সম্মানিত। তাঁর ভারত আক্রমণ আফগানিস্তানে গর্বের গল্প হিসেবে বিবেচিত, কিন্তু ভারতে তা বিপর্যয় আর কষ্টের স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলটি ইতিহাসজুড়ে ভারত আক্রমণের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং পানিপতের উত্তরাধিকার আজও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার একটি সতর্কবার্তা হিসেবে ভারতীয় ইতিহাসে স্মরণ করা হয়।
অন্যান্য আফগান আক্রমণ
আহমদ শাহ আবদালির আগে আরও আফগান শাসক ভারত আক্রমণ করেন—বিশেষত মাহমুদ গজনভি (৯৭১–১০৩০) এবং ঘোরি শাসকগণ যেমন মুহাম্মদ ঘোরি। ১১–১২ শতকের এই আক্রমণগুলোর মাধ্যমে মুসলিম শাসনের ভিত্তি তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে দিল্লি সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
উপসংহার
তাহলে “কোন আফগান সেনাপতি ভারত আক্রমণ করেছিলেন?” এই প্রশ্নের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও প্রভাবশালী উত্তর হলো—আহমদ শাহ আবদালি (আহমদ শাহ দুররানি)। তাঁর একাধিক আক্রমণ ভারতের ক্ষমতার ভারসাম্যকে পরিবর্তন করে দেয়, মুঘলদের দুর্বল করে তোলে, মারাঠাদের দমন করে এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের আধিপত্য স্থাপনের পথ খুলে দেয়।
এই গল্প শুধুই জয়যাত্রা বা লুণ্ঠনের নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়া ও আফগানিস্তানের পারস্পরিক ইতিহাস ও সংযোগের একটি জটিল প্রতিচ্ছবি।
Comments
Post a Comment