Skip to main content

#আফগানিস্তান কবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়?

 

আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসান

আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রাক্তন যুবরাজ মোহাম্মদ দাউদ খান এক প্রায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। সে সময় রাজা মোহাম্মদ জহির শাহ বিদেশে চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলেন। দাউদ খান রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন, ১৯৬৪ সালের সংবিধান বাতিল করেন এবং একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে আফগানিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।

📜 পটভূমি: এক রূপান্তরের পথে রাজ্য

জহির শাহের শাসনকাল (১৯৩৩–১৯৭৩)

মোহাম্মদ জহির শাহ তার পিতার হত্যার পর ১৯৩৩ সালের ৮ নভেম্বর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার চার দশকের শাসনকাল তুলনামূলক স্থিতিশীলতা ও সতর্ক আধুনিকায়নের দ্বারা চিহ্নিত। এই সময়ে ১৯৬৪ সালের সংবিধান প্রবর্তিত হয়, যা আফগানিস্তানকে একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করে এবং নাগরিকদের, এমনকি নারীদেরও, সীমিত রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।

ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ

১৯৭০-এর দশকের শুরুতে আফগানিস্তান খরা ও অর্থনৈতিক চাপে ভুগছিল। রাজপরিবারের ভেতর দুর্নীতির অভিযোগ জোরাল হচ্ছিল, এবং রাজনৈতিক ক্ষোভের সঙ্গে জহির শাহের কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানে ব্যর্থতা একত্র হয়ে অভ্যুত্থানের মঞ্চ তৈরি করেছিল।

মোহাম্মদ দাউদ খান: প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি

দাউদ খান—জহির শাহের চাচাতো ভাই এবং ১৯৫৩–১৯৬৩ সময়কালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী—পশতুন জাতীয়তাবাদসহ জাতীয়তাবাদী আবেগে পুনরায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৩ সালে পশতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবির পক্ষে সোচ্চার হওয়ার কারণে তাকে বরখাস্ত করা হলেও, সামরিক ও অভিজাতদের সমর্থনের কারণে তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল।

💥 ১৯৭৩ সালের অভ্যুত্থান: সময়রেখা ও প্রধান ঘটনা

  • ১৯৭৩ সালের ২৫ জুন: জহির শাহ চোখের চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য ইতালির উদ্দেশ্যে কাবুল ত্যাগ করেন।

  • ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই: রাতের প্রথম দিকে দাউদপন্থী সামরিক ইউনিট এবং পিডিপিএ (পিপলস ডেমোক্রাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান) সংশ্লিষ্ট অফিসাররা কাবুলের বিমানবন্দর ও রাজপ্রাসাদসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। এই ক্ষমতা দখল প্রায় শান্তিপূর্ণ ও দ্রুত ঘটে।

  • সকালের রেডিও ঘোষণায়: দাউদ খান একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।

  • ক্ষয়ক্ষতি: অত্যন্ত সীমিত—মাত্র সাত পুলিশ কর্মকর্তা ও এক ট্যাংক ক্রু হালকা প্রতিরোধে নিহত হয়, যদিও সামগ্রিকভাবে অভ্যুত্থান প্রায় রক্তপাতহীনই ছিল।

  • ১৯৭৩ সালের ২৪ আগস্ট: জহির শাহ ইতালিতে অবস্থানকালে আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং সেখানেই নির্বাসিত থাকেন।

এর মাধ্যমে বারাকজাই রাজবংশের ২২৫ বছরেরও বেশি সময়ের রাজতন্ত্রের শাসনের অবসান ঘটে।

⚖️ রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে

দাউদ খানের প্রজাতন্ত্র

দাউদ অবিলম্বে ১৯৬৪ সালের সংবিধান বাতিল করে প্রেসিডেনশিয়াল প্রজাতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি সংসদ ভেঙে দেন এবং মনোনীত লোয়া জিরগা (মহাসভা) গঠন করেন। তার আদর্শে ইসলামি জাতীয়তাবাদ, আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা ও ভূমি সংস্কারের চেষ্টা অন্তর্ভুক্ত ছিল—যা কমিউনিস্ট এবং রক্ষণশীল উভয়পক্ষকেই ক্ষুব্ধ করেছিল।

অনিচ্ছাকৃত পরিণতি

আফগানিস্তানের সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ভেঙে দেওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা করে। প্রজাতন্ত্র স্থিতিশীল হতে পারেনি, দলাদলি ও সংঘাতে জর্জরিত ছিল। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল-এ কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে হওয়া (সাওর বিপ্লব) অভ্যুত্থান দাউদ খানের শাসনের ইতি টানে, যা বারাকজাই রাজত্বের সমাপ্তিরও ঘোষণা দেয়।

👑 রাজপরিবারের ওপর প্রভাব

  • জহির শাহ: ক্ষমতাচ্যুত হলেও তিনি মর্যাদা হারাননি। ইতালিতে নির্বাসনে থেকে পরবর্তীতে ২০০২ সালে আফগানিস্তানে ফিরলে তাকে "জাতির পিতা" উপাধিতে সম্মানিত করা হয়, যদিও আর কখনো ক্ষমতা ফিরে পাননি।

  • রানি হুমায়েরা: প্রথমে গৃহবন্দী থাকলেও পরে স্বামীর সঙ্গে নির্বাসনে যোগ দেন। আফগানিস্তানে ফেরার ঠিক আগেই তার মৃত্যু হয়।

  • যুবরাজ আহমদ শাহ: রাজতন্ত্র বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মনোনীত উত্তরাধিকারী ছিলেন, ২০২৪ সালে সিংহাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হয়েই তার মৃত্যু ঘটে।

🌐 কেন এটি আজও গুরুত্বপূর্ণ

একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়

এই অভ্যুত্থান কেবল রাজতন্ত্রকেই নয়, আফগানিস্তানের স্বল্পকালীন গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রচেষ্টাকেও ধ্বংস করেছিল। এর পর দেশটি গৃহযুদ্ধ, বিদেশি দখল, সোভিয়েত আগ্রাসন এবং তালেবানের উত্থানের দিকে ধাবিত হয়, যার শিকড় এই পরিবর্তনেই নিহিত।

লোয়া জিরগায় পুনর্বিবেচনা

২০০১ সালের মার্কিন হস্তক্ষেপের পর, ২০০২ সালের লোয়া জিরগা-তে জহির শাহকে পুনরায় সাংবিধানিক রাজা হিসেবে ফিরিয়ে আনার কথাও বিবেচিত হয়েছিল। তিনি যথেষ্ট জনসমর্থন পেয়েছিলেন, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লবিংয়ের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রজাতন্ত্র গঠিত হয় এবং হামিদ কারজাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

📚 শিক্ষাগুলো ও উত্তরাধিকার

  1. নাজুক সংস্কারসমূহ: ১৯৬৪ সালের সংবিধান গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিল, কিন্তু একটিমাত্র ক্ষমতা দখল দুই দশকের পরিমিত অগ্রগতিকে উল্টে দেয়।

  2. নেতৃত্বের ভূমিকা: দাউদ খানের কেন্দ্রীভূত প্রজাতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।

  3. অস্থিতিশীলতার শিকল: রাজতন্ত্রের অবসান আঞ্চলিক মিত্রতায় পরিবর্তন আনে, মতাদর্শগত দলগুলোকে সাহসী করে তোলে এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে আফগানিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পথ প্রশস্ত করে।

📝 উপসংহার

আফগানিস্তানের রাজতন্ত্রের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই-এর প্রারম্ভিক ঘণ্টায়, যখন এক রাজপরিবারের আত্মীয়-পরিণত-রাষ্ট্রপতি প্রায় রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে রাজা জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। শান্তিপূর্ণ হলেও এই মুহূর্তটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে কর্তৃত্ববাদী প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের মাধ্যমে কয়েক দশকের অস্থিতিশীলতার সূচনা করেছিল—একটি জলবিভাজিকা ঘটনা, যার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায়। রাজপরিবার স্মৃতি ও মর্যাদায় টিকে থাকলেও, সিংহাসন চিরতরে হারিয়ে গিয়ে আফগানিস্তানের দীর্ঘ, জটিল ইতিহাসের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটায়।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...