দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের মিত্র দেশসমূহ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত ও বিধ্বংসী যুদ্ধ, যেখানে প্রায় পুরো বিশ্বই দুটি বৃহৎ জোটে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একপাশে ছিল অক্ষশক্তি (Axis Powers) — প্রধানত জার্মানি, ইতালি ও জাপান — অন্যপাশে ছিল মিত্রশক্তি (Allied Powers)। ব্রিটেন ছিল মিত্রশক্তির অন্যতম নেতৃত্বদানকারী দেশ।
এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ব্রিটেন একা লড়েনি। তাদের সাথে জোট বেঁধেছিল বহু দেশ ও উপনিবেশ, যারা নানা ফ্রন্টে ব্রিটেনকে সমর্থন ও সহায়তা করেছে। আসুন জেনে নিই কোন দেশগুলি ছিল ব্রিটিশদের মিত্র এবং কীভাবে তারা এই যুদ্ধে অবদান রেখেছিল।
প্রধান মিত্র শক্তি
যুক্তরাষ্ট্র
প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ছিল, তবে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে প্রবেশ করে। এরপর তারা ব্রিটেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণে যুদ্ধ সরঞ্জাম, খাদ্য ও অর্থ সাহায্য দেয় (Lend-Lease প্রোগ্রামের মাধ্যমে) এবং ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যৌথ অভিযান চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা ডি-ডে (Normandy landings) থেকে শুরু করে জার্মানির পতন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন
১৯৪১ সালের জুনে হিটলার অপারেশন বারবারোসা শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তির সাথে যুক্ত হয়। পূর্ব ফ্রন্টে সোভিয়েত বাহিনী জার্মান বাহিনীকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করে, স্টালিনগ্রাড ও কুরস্কের মত ঐতিহাসিক যুদ্ধে জয়লাভ করে। এতে জার্মানি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পশ্চিম ইউরোপে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চাপ অনেকটা কমে যায়।
চীন
চীন প্রাথমিকভাবে ১৯৩৭ সাল থেকেই জাপানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পরে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রশক্তির অংশ হয়ে যায়। চীনের ভূখণ্ডে জাপানি সৈন্যদের ব্যস্ত রাখার ফলে জাপান প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বেশি সৈন্য পাঠাতে পারেনি। এটি ব্রিটেনের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ছিল।
ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ও উপনিবেশসমূহ
ব্রিটেনের অন্যতম বড় শক্তি ছিল তার বিশাল সাম্রাজ্য ও কমনওয়েলথ দেশসমূহের সমর্থন।
ভারত (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২৫ লাখ ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়, যা ইতিহাসের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তারা আফ্রিকা, ইউরোপ ও বার্মা ফ্রন্টে লড়াই করে। বিশেষত বার্মায় জাপানিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের অবদান উল্লেখযোগ্য।
কানাডা
কানাডা যুদ্ধের প্রথমদিকেই ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। কানাডীয় বাহিনী আটলান্টিকের নৌযুদ্ধ থেকে শুরু করে ইতালি ও নর্ম্যান্ডি পর্যন্ত বহু ফ্রন্টে লড়াই করে।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে লড়াই করে। পরে জাপানের হুমকির কারণে তারা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফোকাস করে, যেখানে নিউগিনি ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অভিযান চলে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার সৈন্যরা পূর্ব আফ্রিকায় ইতালির বিরুদ্ধে ও উত্তর আফ্রিকায় রোমেলের আফ্রিকা কোরের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
ইউরোপীয় মিত্র দেশসমূহ
ফ্রান্স (মুক্ত ফরাসি বাহিনী)
ফ্রান্স ১৯৪০ সালে নাৎসি জার্মানির হাতে পরাজিত হলেও শার্ল দ্য গলের নেতৃত্বে “মুক্ত ফরাসি বাহিনী” (Free French Forces) ব্রিটেনের সাথে মিলে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই চালিয়ে যায়।
পোল্যান্ড
পোল্যান্ড ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাস্থল। দেশটি দখল হয়ে যাওয়ার পর অনেক পোলিশ সৈন্য ব্রিটেনে পালিয়ে এসে RAF-এ যোগ দেয় এবং Battle of Britain-এ অসামান্য অবদান রাখে। পোলিশ সেনারা ইতালি ও নর্ম্যান্ডিতেও লড়াই করে।
বেলজিয়াম, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস ও গ্রীস
এই দেশগুলির সরকার লন্ডনে নির্বাসনে গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তাদের সৈন্য, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে মিলে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করে।
চেকোস্লোভাকিয়া
চেকোস্লোভাক সেনা ও পাইলটরা ব্রিটেনের হয়ে যুদ্ধ করে। তারা বিশেষ করে RAF স্কোয়াড্রনে অংশ নেয় এবং স্যাবোটাজ ও গুপ্তচরবৃত্তির মিশনেও অংশ নেয়।
অন্যান্য মিত্র দেশসমূহ
যুগোস্লাভিয়া
যুগোস্লাভিয়া জার্মানি দ্বারা দখল হওয়ার পরও সেখানে গেরিলা বাহিনী, বিশেষ করে টিটোর পার্টিজানরা, বড় আকারের প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে জার্মান বাহিনী বিপুল পরিমাণ সৈন্য এই অঞ্চলে ব্যস্ত রাখতে বাধ্য হয়।
ব্রাজিল
ব্রাজিল ১৯৪২ সালে মিত্রশক্তির সাথে যুক্ত হয়ে ইতালিতে এক্সপেডিশনারি ফোর্স পাঠায় এবং ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে যুদ্ধ করে।
উপসংহার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল আসলে ব্রিটেনের একক লড়াই নয়। এটি ছিল সমমনা দেশসমূহের এক বিশাল সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি, সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ফ্রন্টে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, চীনের জাপানকে ব্যস্ত রাখা, ভারত ও কমনওয়েলথ দেশের বিপুল সেনাদল — সব মিলিয়েই ব্রিটেন ও মিত্রশক্তি নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিস্ট ইতালি ও সাম্রাজ্যবাদী জাপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।
এই মিত্রতাগুলো দেখায় যে একতা ও যৌথ প্রচেষ্টা কিভাবে বিশ্ব ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই শিক্ষা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক — বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহায়তা ও সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Comments
Post a Comment