ভারতে রানী ভিক্টোরিয়ার সরকার ব্যবস্থা: উপনিবেশের নতুন রূপ
ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশ শাসনের অধ্যায় একটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। এই শাসনের আনুষ্ঠানিক রূপ শুরু হয় রানী ভিক্টোরিয়ার সময়, বিশেষ করে ১৮৫৮ সালের পরে। এ সময়ে ভারত সরাসরি ব্রিটিশ রাজমুকুটের অধীনে আসে।
রানী ভিক্টোরিয়ার সরকার ব্যবস্থা শুধুমাত্র উপনিবেশ শাসন নয়, বরং একটি জটিল প্রশাসনিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল, যা ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আসুন দেখা যাক কীভাবে এই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতো, এর বৈশিষ্ট্য কী এবং এর প্রভাব কতদূর বিস্তৃত ছিল।
কোম্পানি থেকে ক্রাউন শাসনে রূপান্তর
রানী ভিক্টোরিয়ার সরাসরি শাসনের আগে ভারত শাসন করত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই বাণিজ্য সংস্থা ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলে—সেনা গঠন থেকে কর আদায়, এমনকি চুক্তি স্বাক্ষর পর্যন্ত।
কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ (মহাবিদ্রোহ) কোম্পানির শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। এরপর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট “Government of India Act 1858” পাশ করে, যার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় এবং ভারত সরাসরি ব্রিটিশ ক্রাউনের (রানী ভিক্টোরিয়ার) অধীনে আসে।
ফলে রানী ভিক্টোরিয়া হন ভারতের সম্রাজ্ঞী (Empress of India) (১৮৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে), আর ভারত একটি ক্রাউন উপনিবেশে পরিণত হয়।
প্রশাসনিক কাঠামো ও পর্যায়ভিত্তিক শাসন
রানী ভিক্টোরিয়ার সময় ভারতের শাসনব্যবস্থা ছিল ধাপভিত্তিক ও সুসংগঠিত। শীর্ষে ছিলেন ব্রিটেনের রাজারাজ্ঞী (রানী ভিক্টোরিয়া) ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, যারা নীতিনির্ধারণ করতেন।
Secretary of State for India ছিলেন লন্ডনে বসে ভারতের সমস্ত প্রশাসনিক বিষয় দেখভালের প্রধান। তার অধীনে ছিল একটি India Council, যারা তাকে পরামর্শ দিত।
ভারতে সরাসরি রানীর প্রতিনিধি ছিলেন Viceroy (Governor-General)। তিনিই ভারতের সর্বোচ্চ নির্বাহী, সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করতেন। প্রাদেশিক স্তরে ছিল Governors বা Lieutenant-Governors, যাদের মাধ্যমে রাজ্যসমূহ শাসিত হতো।
জেলায় জেলায় ছিল District Collector বা Magistrate, যিনি প্রশাসন ও কর আদায়ের মূল দায়িত্বে ছিলেন। গ্রামীণ স্তরে ছিল মুনসিফ-দারোগা-চৌকিদার প্রভৃতি, যারা সরাসরি প্রজাদের সাথে যুক্ত থাকত।
দেশীয় রাজ্য ও ‘প্রিন্সলি স্টেটস’
রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল প্রিন্সলি স্টেটস বা দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে চুক্তির মাধ্যমে শাসন।
ভারতে প্রায় ৫৬০টি দেশীয় রাজ্য ছিল, যেগুলোর নিজস্ব রাজা-মহারাজা শাসন করতেন। তারা ব্রিটিশ ক্রাউনকে আনুগত্য স্বীকার করলেও, তাদের অভ্যন্তরীণ শাসনে স্বাধীনতা ছিল।
ব্রিটিশরা এই ব্যবস্থা চালু রেখেছিল দুই কারণে:
১. প্রশাসনিক ব্যয় কমানো
২. স্থানীয় শক্তির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
এ রাজ্যগুলিতে ব্রিটিশ Resident বা Political Agent নিযুক্ত থাকত, যারা নজরদারি করত এবং ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষা করত।
আইন ও প্রশাসনিক সেবা
রানী ভিক্টোরিয়ার সরকার ভারতে একটি একক আইনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ইংরেজ কমন-ল’র নীতি ভারতীয় প্রথার সাথে মিলিয়ে নতুন আইনকাঠামো তৈরি হয়। তৈরি হয় High Court, যেখানে ব্রিটিশ আইনজীবী ও বিচারপতিরা কাজ করতেন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ ছিল Indian Civil Service (ICS)। এই উচ্চস্তরের প্রশাসনিক সেবায় প্রথমে কেবল ব্রিটিশদেরই নিয়োগ হতো। ধীরে ধীরে কিছু ভারতীয় সুযোগ পেলেও, কঠিন পরীক্ষা ও বৈষম্যমূলক নীতির কারণে সংখ্যা কম ছিল।
এ ICS কর্মকর্তারাই প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনের মেরুদণ্ড। তারা রাজস্ব সংগ্রহ, আইনশৃঙ্খলা ও নীতিমালা প্রয়োগ করত।
রানীর ঘোষণাপত্র (Queen’s Proclamation)
১৮৫৮ সালে, সিপাহি বিদ্রোহের পর রানী ভিক্টোরিয়া এক প্রকাশ্য ঘোষণাপত্র (Proclamation) দেন। এতে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন:
-
সকল প্রজার ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো হবে,
-
আইন সবার জন্য সমান হবে,
-
মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি হবে, জাতি বা বর্ণের কারণে বৈষম্য হবে না।
এটি ছিল ভারতীয় জনমতকে শান্ত করতে এবং নতুন শাসনের প্রতি আস্থা তৈরি করতে এক কৌশল। যদিও বাস্তবে সবক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি।
অর্থনীতি ও অবকাঠামো
রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনে ভারতে রেলপথ, ডাকব্যবস্থা, টেলিগ্রাফ, সড়ক ও খাল তৈরি হয়। তবে এগুলো প্রধানত ব্রিটিশ শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ ও পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য তৈরি হয়।
কৃষি থেকে নগদ ফসল যেমন নীল, তুলা, আফিম চাষে জোর দেওয়া হয়। ফলে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়ে একাধিক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
সেনাবাহিনী ও পুলিশ
১৮৫৭ এর পরে ব্রিটিশরা ভারতীয় সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করে। একদিকে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যের অনুপাত বাড়ানো হয়, অন্যদিকে ভিন্ন প্রদেশের, ভিন্ন ধর্মের সৈন্যদের আলাদা রাখা হয় যাতে একত্র হয়ে বিদ্রোহ না করতে পারে।
সাথে তৈরি হয় British Indian Police, যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করত, কিন্তু প্রায়শই আন্দোলন দমনে ব্যবহার হতো।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনব্যবস্থা ভারতে আধুনিক অবকাঠামো, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা ও আইনি কাঠামো প্রবর্তন করে। একই সাথে এটি ঔপনিবেশিক শোষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বিভাজনের নীতিও জোরদার করে।
“Divide and Rule” নীতি অনুসারে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা হয়, যা ভারতীয় সমাজকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
উপসংহার: এক জটিল ইতিহাস
ভারতে রানী ভিক্টোরিয়ার সরকার ব্যবস্থা একদিকে ব্রিটিশ শাসনের কঠোরতা, অন্যদিকে প্রশাসনিক আধুনিকতার মিশ্রণ।
ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরও অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন প্রশাসনিক কাঠামো, রেলওয়ে, আইনি ব্যবস্থা ইত্যাদি এই ব্রিটিশ শাসনেরই উত্তরাধিকার বহন করে।
এইভাবে রানী ভিক্টোরিয়ার ভারত শাসন কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, আজও ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরে তার ছাপ রয়ে গেছে।
Comments
Post a Comment