Skip to main content

#ভারতের বিখ্যাত কাওয়ালি গায়কের নাম


ভারতের কিংবদন্তি কাওয়ালি গায়ক: উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান এবং যাঁরা এই ধারাকে বহন করেছেন

সুফিবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কাওয়ালি সংগীত ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীত ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে এক অমোঘ স্থান অধিকার করে আছে। যদিও কাওয়ালির উৎপত্তি ১৩শ শতকের পারস্য ও চিশতিয়া সুফি তরিকার মধ্য দিয়ে, এই শিল্পরূপটি ভারতে প্রসার লাভ করে নানা সুফি সাধক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং পরিবারদের মাধ্যমে। লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে কাওয়ালি পৌঁছে দেওয়া যাঁদের কৃতিত্ব, তাঁদের মধ্যে উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান হলেন সর্বাধিক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাম। যদিও তিনি পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন, তবুও ভারতীয় শ্রোতা ও কাওয়ালি শিল্পীদের উপর তাঁর প্রভাব অপরিসীম।

এখন আমরা দেখে নেব ভারতের বিখ্যাত কাওয়ালি গায়কদের কিছু নাম, বিশেষভাবে নুসরাত ফতেহ আলী খানের প্রভাবের কথা তুলে ধরে।

১. উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান: কাওয়ালির এক বিশ্বজনীন প্রতীক

নুসরাত ফতেহ আলী খান পাকিস্তানের নাগরিক হলেও তাঁর সঙ্গীতিক ঐতিহ্য ভারতীয় শ্রোতাদের মাঝে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। ১৯৪৮ সালে ফয়সালাবাদে জন্মগ্রহণকারী নুসরাত ছিলেন ৬০০ বছরের পুরনো কাওয়ালি পরিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তাঁর গলার জোর, আবেগপূর্ণ সুর এবং শাস্ত্রীয় ও আধুনিক ধারার মেলবন্ধন তাঁকে “শাহেনশাহ-এ-কাওয়ালি” (কাওয়ালির সম্রাট) উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৮০ এবং ৯০-এর দশকে মুম্বাই ও দিল্লিতে তাঁর পারফরম্যান্স ভারতীয় দর্শকদের অভূতপূর্ব সাড়া পায়। এ আর রহমান ও বলিউড পরিচালকদের সঙ্গে তাঁর যৌথ কাজ কাওয়ালিকে মূলধারার ভারতীয় সিনেমায় নিয়ে আসে। আফরিন আফরিন, পিয়া রে পিয়া রে, কিন্না সোনা তেনু—এসব গান আজও অমর।

যদিও পাকিস্তানি, তাঁর আধ্যাত্মিক বার্তা সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আজও তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা যায় ভারতীয় ঘরে, রেডিওতে এবং সুফি দরগাহগুলোতে।

২. সাবরি ব্রাদার্স: ভারতে ধারাবাহিকতা

সাবরি ব্রাদার্স মূলত পাকিস্তানের হলেও তাঁদের সংগীতধারার অনেক অনুসারী ও উত্তরাধিকারী ভারতে কাওয়ালির ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। তাঁদের গান rhythmic handclap, সুফি কাব্যিকতা এবং উচ্চগ্রামী গলার ব্যবহারে পরিপূর্ণ।

ভারতে আসলাম সাবরি-এর মতো শিল্পীরা সাবরি স্টাইলের কাওয়ালিকে জনপ্রিয় করেছেন। তাঁর গাওয়া ভর দো ঝোলি মেরি, তাজদার-এ-হারাম এখনও বহু লোকের হৃদয়ে দোলা দেয়।

৩. আজিজ মিয়ান কাওয়াল: সাহসী কন্ঠস্বর

আজিজ মিয়ান ছিলেন কাওয়ালির এমন একজন গায়ক যিনি ছিলেন প্রচলিত ধারার বাইরে। গভীর দার্শনিক ও প্রশ্নাত্মক বাণীতে ভরপুর তাঁর গান ভারতীয় শ্রোতাদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল।

ভারতের অনেক কাওয়াল যেমন আসলাম ওয়ারসি, হাজি মকবুল সাবরির শিষ্যরা তাঁর সাহসী গায়কি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে নিজেদের পরিবেশনা গড়ে তুলেছেন।

৪. ভারতের নিজস্ব কাওয়ালি কিংবদন্তিরা

এখন চলুন দেখা যাক ভারতের নিজস্ব কিছু বিখ্যাত কাওয়াল শিল্পী যাঁরা নিজেদের প্রতিভা দিয়ে কাওয়ালিকে সমৃদ্ধ করেছেন।

ক) আসলাম সাবরি

আসলাম সাবরি হলেন দিল্লির একজন বিশিষ্ট কাওয়াল যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারফর্ম করেছেন। তাজদার-এ-হারাম এবং ভর দো ঝোলি তাঁর কণ্ঠে খুব জনপ্রিয়।

তিনি হযরত নিজামউদ্দিন দরগা, উরস উৎসব ইত্যাদিতে নিয়মিত পারফর্ম করেন এবং চিশতিয়া ধারার কাওয়ালিকে জীবন্ত করে তোলেন।

খ) নিজামী ব্রাদার্স

নিজামী ব্রাদার্স—উস্তাদ চাঁদ নিজামী, শাদাব ফারিদি নিজামী ও সোহরাব ফারিদি নিজামী—৭০০ বছরের কাওয়ালি ঐতিহ্যের ধারক, যা শুরু হয়েছিল আমীর খসরু-এর হাত ধরে। তাঁরা হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় নিয়মিত পরিবেশন করেন এবং দেশ-বিদেশে বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন।

তাঁদের পরিবেশিত ছাপ তিলক, মান কুনতো মওলা, দমা দম মস্ত কালান্দর আজও নতুন প্রজন্মকে মুগ্ধ করে।

গ) ওয়ারসি ব্রাদার্স

হায়দরাবাদ-ভিত্তিক ওয়ারসি ব্রাদার্স দিল্লি ঘরানার কাওয়ালি পরিবেশন করে থাকেন। তাঁরা সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার-এ ভূষিত হন এবং কাওয়ালির শাস্ত্রীয় শৈলী রক্ষা ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

তাঁরা আজমের শরীফ, নিজামউদ্দিন দরগা সহ আন্তর্জাতিক সুফি উৎসবগুলোতেও পারফর্ম করে থাকেন।

৫. বলিউড ও কাওয়ালির পুনর্জাগরণ

১৯৫০-৮০ দশকের মধ্যে বলিউড কাওয়ালিকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, উদিত নারায়ণ, সোনু নিগম-এর মতো শিল্পীরা সিনেমায় কাওয়ালি স্টাইলের গান গেয়ে তা আরও জনপ্রিয় করেন।

কিছু বিখ্যাত সিনেমার কাওয়ালি গান:

  • না তো কাফিলা কি তালাশ হ্যায়বারসাত কি রাত

  • পরদা হ্যায় পরদাআমর অাকবর অ্যান্টনি

  • তুমহে দিল্লাগি ভুল যানি পড়েগি – (নুসরাতের গানের অনুপ্রেরণায়)

আধুনিক কালে এ আর রহমান কাওয়ালি ও সুফি ধারাকে জনপ্রিয় করেছেন খ্বাজা মেরে খ্বাজা (যোধা আকবর) ও পিয়া হাজি আলি (ফিজা)-র মতো গান দিয়ে।

৬. ভারতের কাওয়ালির ভবিষ্যৎ

ভারতে কাওয়ালির ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উজ্জ্বল। অনেক তরুণ কাওয়াল পুরনো রীতি শিখে নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তির সহায়তায় নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। সংগীত নাটক অকাদেমি এবং ভারতের বিভিন্ন সুফি ফাউন্ডেশন কাওয়ালি বিষয়ক ওয়ার্কশপ ও উৎসব আয়োজন করছে।

ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি কাওয়ালিদের বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করে তুলছে। রুহানিয়াত, সুফিয়ানা কাওয়ালি, স্টুডিও নিজামী ইত্যাদি চ্যানেলগুলো নিয়মিত পারফরম্যান্স প্রকাশ করে।

উপসংহার

কাওয়ালি কেবল গান নয়; এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা। আসলাম সাবরি, নিজামী ব্রাদার্স, ওয়ারসি ব্রাদার্স-এর মতো শিল্পীরা ভারতের চিশতিয়া সুফি ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মাঝে বহন করে চলেছেন।

যদিও উস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খান এই ধারায় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন এবং ভারতেও তাঁর প্রভাব গভীর, ভারতীয় কাওয়ালরা নিজেদের প্রতিভা ও নিবেদনে এই পবিত্র সংগীতধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দিল্লির দরগাহর উঠোন থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চ পর্যন্ত কাওয়ালি তার চিরন্তন বার্তা নিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে—প্রেম ও ঐক্যের আহ্বান।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

#What were the reasons for the conflict between the French, Spanish, Portuguese and the East India Company in India and what war was fought with them?

  The Great Game in the East: Why European Powers Clashed in India SEO Keywords: East India Company, Carnatic Wars, Anglo-French rivalry, European colonization India, Battle of Plassey, Battle of Wandiwash, colonial conflicts India, European trade monopolies, decline of Mughal Empire, Indian history WordPress Categories: History, Colonialism, India, European Powers, Wars, Trade The 17th and 18th centuries witnessed a dramatic transformation in India, as the vast and wealthy subcontinent became a battleground for European colonial ambitions. What began as a pursuit of lucrative trade quickly escalated into intense rivalries, culminating in a series of devastating wars that fundamentally reshaped India's destiny. The French, Spanish, Portuguese, and the formidable English East India Company were the key players in this intricate and often brutal "Great Game in the East," driven by economic greed, political power, and a fierce desire for supremacy. The Lure of the East: A ...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...