Skip to main content

#খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া।


খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.): প্রেম, মানবতা ও আধ্যাত্মিকতার অমর বাতিঘর

দিল্লির বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.), যিনি “মেহবুব-ই-ইলাহি” (আল্লাহর প্রিয়তম) নামে খ্যাত, উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। চিশতিয়া তরিকার এই মহাপুরুষ প্রেম, সহনশীলতা, দয়া, ও মানবসেবার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষের হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

জন্ম ও শৈশব

খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন ১২৩৮ খ্রিস্টাব্দে (৬৩৬ হিজরি) ভারতের উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁ শহরে। তিনি এক সম্ভ্রান্ত সৈয়্যেদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যারা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বংশধর। তাঁর পিতার নাম ছিল সৈয়্যেদ আহমদ বদায়ুনি, যিনি তাঁর মৃত্যুর পরপরই নিজাম উদ্দিনকে এতিম করে যান। এরপর তাঁর মা বিবি জুলেখা অত্যন্ত পরহেজগারি ও ত্যাগের মাধ্যমে তাঁকে বড় করেন।

ছোটবেলা থেকেই নিজাম উদ্দিন আধ্যাত্মিক বিষয়ে গভীর আগ্রহী ছিলেন। দিল্লিতে এসে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন, ফিকহ, হাদীস, তাফসির ইত্যাদি শাস্ত্রে পারদর্শী হন। তবে বাহ্যিক শিক্ষার বাইরেও তাঁর মন ছুটে চলত আধ্যাত্মিক সত্য ও হৃদয়ের শুদ্ধতার দিকে।

সুফি তরিকায় দীক্ষা

প্রায় ২০ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানের পাকপত্তন (তৎকালীন আজোধন)-এ যান এবং বিখ্যাত সুফি সাধক হযরত বাবা ফরিদুদ্দিন গঞ্জে শাকর (রহ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাধনার পর বাবা ফরিদ (রহ.) তাঁকে নিজের খলিফা নিযুক্ত করে দিল্লিতে ফিরে গিয়ে সুফি তরিকাকে ছড়িয়ে দিতে বলেন।

নিজাম উদ্দিন আউলিয়া দিল্লিতে ফিরে গিয়াসপুরে (বর্তমানে দক্ষিণ দিল্লি) একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্রে রূপ নেয়।

খানকাহ ও জনসেবা

হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার খানকাহ ছিল সকল শ্রেণির, ধর্মের, জাতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার গরিব ও নিঃস্ব মানুষ আশ্রয়, আহার এবং সান্ত্বনা পেত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত লঙ্গরখানা কখনো বন্ধ হতো না; সারাবছর দিনরাত সেখানে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ হতো।

তাঁর খানকাহে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা নয়, প্রেম, সহমর্মিতা, ক্ষমাশীলতা ও মানবিকতা শেখানো হতো। যেকোনো আর্ত বা দুঃস্থ মানুষ তাঁর দরজায় এলে খালি হাতে ফিরতে হতো না।

রাজনীতি থেকে দূরত্ব

নিজাম উদ্দিন আউলিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সুলতানদের কাছ থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রেখেছেন। তিনি বলতেন:হামারি খানকাহ মে সুলতানোঁ কা আনা মানা হ্যায়অর্থাৎ— “আমার খানকাহে রাজাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।”

এই মনোভাবের জন্য তিনি অনেক সুলতানের বিরাগভাজন হন। বিশেষ করে গিয়াসউদ্দিন তুঘলকমহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তবে তিনি কখনো রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আন্দোলন করেননি; বরং আল্লাহর প্রেমে মগ্ন থাকাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

শিক্ষা ও দর্শন

হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার সুফিবাদ ছিল হৃদয়কেন্দ্রিক— বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে আন্তরিকতা ও ঈশ্বরপ্রেমে তিনি অধিক গুরুত্ব দিতেন। তাঁর দর্শনের মূল পয়েন্টগুলো ছিল:

১. ঈশ্বরপ্রেম (ইশক-এ-হকিকি)

আল্লাহর প্রেমই মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য। এই প্রেম মানুষকে অহংকার, হিংসা, লোভ থেকে মুক্ত করে।

২. মানবসেবা

তিনি বলতেন, "একজন মানুষ যদি খেয়ে ঘুমায়, আর তার প্রতিবেশী যদি না খেয়ে থাকে, তবে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না।"

৩. সংগীত ও কাওয়ালি

আধ্যাত্মিক চেতনা জাগানোর জন্য তিনি কাওয়ালির মাধ্যমে ‘সামা’ পদ্ধতিকে উৎসাহ দিতেন। তাঁর খানকাহে অনেক সময় গভীর রাতে পর্যন্ত কাওয়ালি চলত, যেখানে আল্লাহর প্রেমের গান মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করত।

৪. সহনশীলতা ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি

হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলকেই তিনি আপন মনে করতেন। তাঁর কাছে মানুষই ছিল প্রধান, ধর্ম ছিল না বিভাজনের মাধ্যম।

বিখ্যাত শিষ্য

হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য ছিলেন আমির খসরু (রহ.) — উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, সংগীতজ্ঞ ও সুফি। আমির খসরু তাঁকে শুধু গুরু হিসেবে নয়, পিতা ও প্রেমমূর্তি হিসেবেও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর অনেক কবিতাই প্রিয় গুরুর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন।

অলৌকিক ঘটনা

তাঁর জীবনে বহু কারামাত (আধ্যাত্মিক অলৌকিক ঘটনা) ঘটেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। যেমন— খাদ্যের অভাবেও বহু মানুষকে খাওয়ানোর জন্য খাবার বৃদ্ধি, অসুস্থকে সুস্থ করে তোলা ইত্যাদি।

একবার সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর বিরুদ্ধে রুষ্ট হন, কারণ শ্রমিকরা গোপনে তাঁর খানকাহে কাজ করতে আসত। তখন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া বলেন:হনুজ দিল্লি দূর অস্ত” — অর্থাৎ “দিল্লি এখনও অনেক দূরে।”

এই ভবিষ্যদ্বাণীর কিছুদিন পরই দিল্লি ফেরার পথে সুলতান দুর্ঘটনায় নিহত হন।

মৃত্যু ও উরস

হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে (৭২৫ হিজরি) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজার নামাজে অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লির নিজামউদ্দিন দরগাহে শায়িত আছেন, যা আজও একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

প্রতিবছর তাঁর উরস ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়, যেখানে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ আসেন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

আজকের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

বর্তমান বিশৃঙ্খল ও ঘৃণাভিত্তিক সমাজে হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার দর্শন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি শিখিয়েছেন ভালোবাসাই ধর্মের আসল মূর্তি, এবং প্রকৃত তাসাউফ মানে হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও মানবসেবা

যেখানে ধর্মের নামে হিংসা ছড়াচ্ছে, সেখানে এই মহাপুরুষের শিক্ষা হতে পারে একটি শান্তিময় বিকল্প পথ।

উপসংহার

খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) শুধু একজন সুফি সাধক নন, বরং আল্লাহর প্রেম ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর শিক্ষা এবং জীবন আজও মানুষের হৃদয়ে আলো ছড়ায়, বিভেদের মাঝে একতার বার্তা দেয়। যাঁরা সত্য, মানবতা ও আত্মার মুক্তি খোঁজেন, তাঁদের জন্য তিনি চিরকালীন দৃষ্টান্ত।

আল্লাহ তাঁর রূহকে নুরে ভরিয়ে দিন। আমিন।


Comments

Popular posts from this blog

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

#What were the reasons for the conflict between the French, Spanish, Portuguese and the East India Company in India and what war was fought with them?

  The Great Game in the East: Why European Powers Clashed in India SEO Keywords: East India Company, Carnatic Wars, Anglo-French rivalry, European colonization India, Battle of Plassey, Battle of Wandiwash, colonial conflicts India, European trade monopolies, decline of Mughal Empire, Indian history WordPress Categories: History, Colonialism, India, European Powers, Wars, Trade The 17th and 18th centuries witnessed a dramatic transformation in India, as the vast and wealthy subcontinent became a battleground for European colonial ambitions. What began as a pursuit of lucrative trade quickly escalated into intense rivalries, culminating in a series of devastating wars that fundamentally reshaped India's destiny. The French, Spanish, Portuguese, and the formidable English East India Company were the key players in this intricate and often brutal "Great Game in the East," driven by economic greed, political power, and a fierce desire for supremacy. The Lure of the East: A ...

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...