:
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.): এক আত্মদর্শী সুফি সাধকের জীবন ও শিক্ষা
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) ইসলামি আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ৯ম শতাব্দীর একজন মহান সুফি সাধক, যিনি আত্মনিবেদন, আত্মদর্শন এবং আল্লাহর প্রেমে বিলীন হওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর জীবন, বাণী এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা আজও বিশ্বের লক্ষ কোটি মুসলমান ও সাধকদের অনুপ্রেরণার উৎস।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর পূর্ণ নাম ছিল আবু ইয়াজিদ তাইফুর ইবনে ঈসা ইবনে সুরুশান আল-বোস্তামী। তিনি ইরানের উত্তরাঞ্চলের বোস্তাম নগরীতে আনুমানিক ৮০৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃপুরুষগণ পারস্যের বাসিন্দা ছিলেন এবং তাঁর দাদা সুরুশান একজন অগ্নি উপাসক (জরথুস্ট্রবাদী) ছিলেন, যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
শৈশব থেকেই বায়েজিদ (রহ.) ছিলেন গভীর চিন্তাবিদ, আত্মপ্রবণ এবং ধ্যানমগ্ন। তিনি খুব অল্প বয়সেই কুরআন হিফজ করেন এবং ইসলামি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তবে তাঁর অন্তরের আকর্ষণ ছিল বাহ্যিক আচার-আচারের চেয়ে অধিকতর গভীর, আত্মিক সত্যের প্রতি।
আত্মিক অভিযাত্রা ও সুফিবাদের পথে পদার্পণ
ইসলামি শাস্ত্র ও হাদিস অধ্যয়নের পাশাপাশি বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) আত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হন। তিনি দুনিয়ার মোহ ও বৈষয়িক জীবন ত্যাগ করে নিঃস্বভাবে আল্লাহর প্রেম ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি দীর্ঘদিন উপবাস, ধ্যান, নিঃশব্দ ইবাদত এবং আত্মশুদ্ধির অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
তিনি বলেন:
“আমি নিজেকে এতটাই শুদ্ধ করেছি যে, যখন আমি আমার আত্মাকে খুঁজলাম, তখন সেখানে কাউকে দেখতে পেলাম না—সেখানে শুধু আল্লাহ ছিলেন।”
এটি হলো ‘ফানা ফিল্লাহ’ তথা আল্লাহর মাঝে আত্মবিলীন হওয়ার সুফি মতবাদ, যার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)।
বিখ্যাত বাণী ও আত্মদর্শনের প্রকাশ
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর কিছু উক্তি তাকে সমকালীন ইসলামি সমাজে বিতর্কিত করলেও সুফি সাধকরা সেগুলিকে গভীর আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর এক বিখ্যাত উক্তি:
“সুবহানি! সুবহানি! আমার গৌরব কত মহান!”
এই উক্তি শুনে অনেকেই হতবাক হন, কিন্তু সুফিদের মতে এটি আল্লাহর প্রেমে সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জনের ফল। বায়েজিদ তাঁর ‘আমি’ সত্তাকে মুছে দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বে নিজেকে বিলীন করেছিলেন।
আরেকটি বিখ্যাত উক্তি:
“আমি বায়েজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম, যেমন সাপ তার খোলস ছাড়ে। তারপর আমি তাকিয়ে দেখলাম—সেখানে কেবল তিনিই রয়েছেন।”
এখানে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, আত্মনাশ (ফানা)-এর মাধ্যমে তিনি একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বই উপলব্ধি করেছেন।
আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দর্শন
বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ করতে হলে আত্মা ও অন্তরের শুদ্ধি অপরিহার্য। বাহ্যিক আমল যতই হোক না কেন, যদি অন্তর কলুষিত হয় তাহলে তা প্রকৃত ইবাদত নয়। তিনি আত্মজ্ঞানকে সর্বোচ্চ স্তরের ইবাদত হিসেবে গণ্য করতেন।
তিনি বলেন:
“আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল নিজেকে জানা।”
এই উক্তিটি ইসলামি আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রীয় মর্মবাণী— “যে নিজেকে চিনে, সে তার প্রভুকে চিনে”—এই হাদিসের প্রতিধ্বনি বহন করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব ও বাংলাদেশে স্মৃতিচিহ্ন
যদিও হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) জীবদ্দশায় ভারতবর্ষে আসেননি, তথাপি তিনি উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশেষত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরে তাঁর নামে একটি পবিত্র মাজার অবস্থিত, যেটি বায়েজিদ বোস্তামী মাজার নামে পরিচিত।
এই মাজার সংলগ্ন একটি পুকুরে বিরল প্রজাতির কালো কচ্ছপ দেখা যায়, যাদের স্থানীয়ভাবে "বোস্তামী কচ্ছপ" বলা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই কচ্ছপগুলো তার আধ্যাত্মিক শক্তির আশীর্বাদপ্রাপ্ত বা কোনো অলৌকিক ঘটনার ফল। যদিও আধুনিক বিজ্ঞান এদের একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তবুও আধ্যাত্মিক গুরুত্বে কচ্ছপগুলো আজও তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) আনুমানিক ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর আসল কবর ইরানের বোস্তাম নগরীতেই অবস্থিত। সেখানে তাঁর নামে একটি মসজিদ ও মাজার নির্মিত হয়েছে, যেখানে বহু মানুষ জিয়ারত করতে যান।
তাঁর মৃত্যুর পর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা, উক্তি এবং ধ্যানের ধারা বিশ্বের বহু সুফি সাধকের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম গাজ্জালি, হযরত জুনাইদ বাগদাদী, ইমাম রুমি (রহ.) প্রমুখ তাঁর জীবন ও শিক্ষায় প্রভাবিত হয়েছেন।
উপসংহার
হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) ছিলেন এক উঁচুস্তরের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিসম্পন্ন সাধক, যিনি আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তিনি সুফিবাদের এমন এক ধারা প্রচলন করেন, যা বাহ্যিক রীতিনীতির গণ্ডি পেরিয়ে অন্তরের গভীরে পৌঁছাতে উৎসাহ দেয়। তার জীবন ও দর্শন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকার ইবাদত কেবল নিয়ম পালনে নয়, বরং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর প্রেমে আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিহিত।
বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)-এর বাণী ও পথনির্দেশনা আজও আমাদের আত্মিক উন্নয়নের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
Comments
Post a Comment