মহাস্থানগড়: বাংলার গৌরবময় প্রাচীন ঐতিহ্যের আসন
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের হৃদয়ে অবস্থিত মহাস্থানগড় বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক চিরন্তন সাক্ষী। অঞ্চলটির প্রাচীনতম নগর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মহাস্থানগড় তার শিকড় গেড়ে রেখেছে, যা করতোয়া নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতার প্রাণময় জীবনের ঝলক আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। এই স্থান শুধুমাত্র ধ্বংসাবশেষের একটি স্তূপ নয়; এটি এক জীবন্ত জাদুঘর, যেখানে রাজনীতির ক্ষমতা, আধ্যাত্মিক ভক্তি এবং সহস্রাব্দ জুড়ে চলা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গল্পগুলো বলা হয়।
মহাস্থানগড়ের উৎপত্তি
বিশ্বাস করা হয় মহাস্থানগড়ের ইতিহাস অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছে, যা এটিকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম নগর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থল হিসেবে প্রমাণ করে। এর নাম সংস্কৃত শব্দ ‘মহা’ (মহান) এবং ‘স্থান’ (স্থান) থেকে এসেছে, যার অর্থ দাঁড়ায় “মহান স্থান।” প্রাচীন গ্রন্থে এই নগরীর নাম ছিল পুণ্ড্রনগর, যা ঐতিহাসিক পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী হিসেবে উল্লেখিত। বহু প্রাচীন সংস্কৃত ও বৌদ্ধ গ্রন্থে এই অঞ্চলের কথা এসেছে, যা স্থানীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এর গুরুত্ব প্রমাণ করে।
প্রথমে ১৮০৮ সালে বুকানন হ্যামিল্টন এই স্থানের তাৎপর্য নথিভুক্ত করেন। পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের জনক আলেকজান্ডার কানিংহাম এখানে অনুসন্ধান চালান। তখন থেকে মহাস্থানগড় বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে, যেখানে মোর্য যুগের আগের সময় থেকে মুসলিম আমল পর্যন্ত মানব বসতির নানা স্তর উন্মোচিত হয়েছে।
প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গনগরী ও নগর ঐশ্বর্য
মহাস্থানগড়ের কেন্দ্রে রয়েছে একটি চমকপ্রদ প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গনগরী। আয়তাকার এই দুর্গ প্রায় ১৮৫ হেক্টর (প্রায় ১.৮৫ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। কাদা ও ইটের তৈরি প্রতিরক্ষা প্রাচীরগুলো এখনো কোথাও কোথাও ১১-১৩ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে, যা এক সময়ের প্রাণচঞ্চল নগর কেন্দ্রকে ঘিরে রেখেছিল। এই দেয়ালগুলোর মূল নকশায় গেট ও বুরুজ ছিল, যা উন্নত নগর পরিকল্পনা ও সামরিক দূরদৃষ্টির সাক্ষ্য বহন করে।
এই দুর্গ প্রাচীরের ভেতরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা রাজপ্রাসাদ, মন্দির, আবাসিক এলাকা ও নাগরিক স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন। জটিল নালা-ব্যবস্থার প্রমাণ এখানে নগর জীবনের উচ্চতর মানও প্রকাশ করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে বৃহদাকার ইটের স্থাপনা ও ব্রাহ্মী লিপিতে খোদাই করা পাথরের ফলক, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর এবং মোর্য সম্রাট অশোকের শাসনের কথাও উল্লেখ করে।
বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
মহাস্থানগড় শুধু রাজনৈতিক কেন্দ্রই ছিল না; এটি বহু শতাব্দী ধরে আধ্যাত্মিক জীবনেরও এক প্রাণকেন্দ্র ছিল। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং পরবর্তীতে ইসলামী প্রভাবের এক বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণ ঘটেছে। মহাস্থানগড়ের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা স্থানীয়ভাবে ‘ভিটা’ নামে পরিচিত উঁচু টিলাগুলো প্রতিটি প্রাচীন বিহার, স্তূপ, মন্দির বা বসতির প্রতীক।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গোবিন্দ ভিটা, যা দুর্গের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। এখানে ৩য় শতাব্দীর একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে বলে মনে করা হয়। খননকাজে এখানে হিন্দু দেবদেবীর ও পৌরাণিক কাহিনীর দৃশ্যাবলী সম্বলিত টেরাকোটার ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে, যা হিন্দু শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশের সাক্ষী।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে বৌদ্ধধর্মও এখানে গভীর ছাপ ফেলেছিল। বহু স্তূপ ও মঠের ধ্বংসাবশেষ প্রমাণ করে যে মহাস্থানগড় এক সময় বৌদ্ধ শিক্ষা ও তীর্থযাত্রার কেন্দ্র ছিল। এই বহুধর্মীয় ইতিহাস মুসলিম শাসনের আমলেও চলতে থাকে, যার প্রমাণ মধ্যযুগীয় সুলতানি যুগের মুদ্রা, মৃৎপাত্র ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষে পাওয়া যায়।
প্রাচীন নিদর্শন ও শিলালিপি: অতীতের কণ্ঠস্বর
মহাস্থানগড়ের খনন থেকে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে টেরাকোটার মূর্তি, শৈল্পিক ফলক, পুঁতি, সীলমোহর এবং ব্রাহ্মী, প্রাকৃত ও পরবর্তীতে আরবি লিপিতে লেখা শিলালিপি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি হলো খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীর চুনাপাথরের ফলক, যা সম্ভবত কোনো ভূমি দান বা প্রশাসনিক নথি ছিল।
এসব আবিষ্কার শুধুমাত্র প্রশাসনিক রীতি বুঝতে সাহায্য করে না, বরং মহাস্থানগড়ের বিস্তৃত বাণিজ্য নেটওয়ার্কের কথাও বলে, যা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অংশ ও দূর ভূমির সাথে যুক্ত ছিল। যেমন, রোমান মুদ্রার খোঁজ পাওয়া মহাস্থানগড়ের সাথে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাণিজ্য সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়।
কিংবদন্তি ও লোককাহিনী
মহাস্থানগড় স্থানীয় লোককাহিনীতে ভরপুর। সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো শাহ সুলতান বলখি মাহিসওয়ার এর কাহিনী, যিনি এক মুসলিম সাধক বলে ধারণা করা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি মাছের পিঠে চড়ে এসেছিলেন এবং হিন্দু রাজা পরশুরামের সাথে আধ্যাত্মিক যুদ্ধ করেছিলেন। দুর্গের কাছেই শাহ সুলতানের মাজার এখনও হাজারো ভক্তকে আকর্ষণ করে, যা এই প্রাচীন স্থানে জীবন্ত ঐতিহ্যের আরেকটি স্তর যোগ করে।
মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ
বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মহাস্থানগড়কে সংরক্ষিত স্থান হিসেবে দেখভাল করছে এবং এটি একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল হিসেবে স্বীকৃত। মহাস্থানগড় জাদুঘরে খনন থেকে প্রাপ্ত বহু নিদর্শন রাখা হয়েছে, যেখানে দর্শনার্থীরা টেরাকোটা ভাস্কর্য, প্রাচীন মুদ্রা, মৃৎপাত্র ও শিলালিপি কাছ থেকে দেখতে পায়, যা এই স্থানের দীর্ঘ ইতিহাসের গল্প বলে।
তবে এত বড় একটি স্থাপনা সংরক্ষণ করা সহজ কাজ নয়। ক্ষয়, অনিয়ন্ত্রিত কৃষিকাজ ও মানুষের আগ্রাসন এর ভঙ্গুর কাঠামোর জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রত্নতত্ত্ববিদ, সংরক্ষণবিদ ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এই অমূল্য ঐতিহ্যকে রক্ষায় অত্যন্ত প্রয়োজন।
কেন মহাস্থানগড় এখনও গুরুত্বপূর্ণ
মহাস্থানগড় শুধুমাত্র একটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নয়; এটি বাংলাদেশের গভীর-প্রোথিত ইতিহাস ও বহুধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। ইতিহাসবিদদের জন্য এটি প্রাচীন বাংলার নগরজীবনের এক বিরল জানালা। আর সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এটি রাজা, ব্যবসায়ী, সন্ন্যাসী ও সাধারণ মানুষের গল্পের সাথে সরাসরি সংযোগের এক অসাধারণ সুযোগ।
এই স্থান আমাদের শেখায় কিভাবে সভ্যতা গড়ে ওঠে ও একে অপরের সাথে মিশে যায়, এবং শিল্প, ধর্ম ও বাণিজ্য কিভাবে সমাজকে রূপ দেয়। একইসাথে, এটি আমাদের যৌথ ঐতিহ্য সংরক্ষণের গুরুত্বও মনে করিয়ে দেয়, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এগুলো থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিতে পারে।
✅ উপসংহার
মহাস্থানগড় বাংলাদেশের ইতিহাসের মুকুটে এক অনন্য রত্ন — যেখানে ইট ও পাথর আজও প্রাচীন গৌরবের গল্প বলে চলে। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী থেকে এক বহুধর্মীয় আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে এর রূপান্তর বাংলার বিবর্তনের এক জীবন্ত গাথা। এই অসাধারণ স্থাপনাটি ঘুরে দেখা ও সংরক্ষণ করে আমরা শুধু পূর্বপুরুষদের স্মৃতিই নয়, মানবজাতির চিরন্তন শিল্প, বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের সন্ধানকেও সম্মান জানাই।
Comments
Post a Comment