মহাস্থানগড়: বাংলার প্রাচীন গৌরবের চিরন্তন দূর্গ
বাংলাদেশের বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর শান্ত তীরে অবস্থিত মহাস্থানগড় — দেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং সহস্রাব্দ ধরে মানব সভ্যতার নীরব সাক্ষী। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক পর্যন্ত ইতিহাসে এর যাত্রা, মহাস্থানগড়কে এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ইতিহাসপ্রেমী, অভিযানপ্রিয় অথবা বাংলার প্রাচীন শিকড় সম্পর্কে কৌতূহলী যে কোনো মানুষের জন্য, মহাস্থানগড় এক দূর অতীতের রহস্যময় জগতে ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়।
উৎপত্তি: পুণ্ড্রনগর, পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী
প্রাচীনকালে মহাস্থানগড় পরিচিত ছিল পুণ্ড্রনগর নামে, যা ঐতিহাসিক রাজ্য পুণ্ড্রবর্ধন এর রাজধানী শহর। মহাভারত, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ও পর্যটকদের বর্ণনায় এই শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ নগর এক সময় প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মহাস্থানগড় নামের অর্থ আনুমানিকভাবে “মহাপবিত্র স্থান।” প্রায় ৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ স্থান, যেখানে প্রায় ১.৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইটের প্রাচীরঘেরা উঁচু দূর্গ রয়েছে। বন্যা ও আক্রমণ থেকে অভ্যন্তরীণ নগর রক্ষার জন্য তৈরি এই উঁচু মঞ্চের অবশিষ্টাংশ আজও আশেপাশের সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৫ ফুট ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।
সময়ের পথ ধরে: প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ
মহাস্থানগড়ে খননকাজে একের পর এক সভ্যতার স্তর উন্মোচিত হয়েছে — মौर্য, গুপ্ত, পাল, সেন যুগ পেরিয়ে মুসলিম শাসনকাল পর্যন্ত। প্রাচীনতম আবিষ্কার যেমন ছাপমারা মুদ্রা, টেরাকোটা ফলক, ও নর্দান ব্ল্যাক পলিশড ওয়্যার (NBPW) প্রমাণ করে যে খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকেই এখানে একটি ব্যস্ত নগর গড়ে উঠেছিল।
বিখ্যাত আবিষ্কারগুলির মধ্যে রয়েছে:
-
গোবিন্দ ভিটা মন্দির: দূর্গের উত্তরে রয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি ক্ষুদ্র হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এটি এ অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ উপাসনার সহাবস্থানের প্রমাণ বহন করে।
-
বৈরাগীর ভিটা, পরশুরামের ভিটা ও মঙ্কালী কুণ্ড: দূর্গের ভিতর ও চারপাশের এই ঢিবি থেকে মূর্তি, শিলালিপি ও স্থাপনার অংশ পাওয়া গেছে, যা ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও নগর পরিকল্পনার উৎকর্ষতার সাক্ষ্য দেয়।
-
শিলালিপি ও সিলমোহর: ব্রাহ্মী, সংস্কৃত ও পরবর্তী লিপিতে খোদিত শিলালিপি থেকে বিভিন্ন সময়ের প্রশাসন, ভূমি দান ও ধর্মীয় অনুদানের তথ্য জানা যায়।
-
দৈনন্দিন জীবনের নিদর্শন: মৃৎপাত্র, মণি, অলঙ্কার, লোহার সরঞ্জাম এমনকি হাড়ের পাশা প্রমাণ করে মহাস্থানগড়ের জনজীবন কত প্রাণবন্ত ছিল।
এ স্থান দক্ষিণ এশিয়ার তক্ষশিলা, পাটলিপুত্রের মতো প্রাচীন মহানগরীর সাথে তুলনীয় এর আকার ও ইতিহাসের কারণে।
দূর্গ: শক্তির দূর্গকুঠি
মহাস্থানগড়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর বিশাল প্রতিরক্ষা প্রাচীর। প্রধানত পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি এই প্রাচীর প্রায় ৫ মিটার পর্যন্ত চওড়া এবং একসময় অনেক উঁচু ছিল। ধারণা করা হয় চারটি প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশ নিশ্চিত করা হতো, আর নির্দিষ্ট ব্যবধানে বেষ্টনীতে তৈরি বুরুজ নিরাপত্তা বাড়াতো।
এই দূর্গ কৌশলগতভাবে নকশা করা হয়েছিল যাতে সামরিক হুমকি ও করতোয়ার বার্ষিক বন্যা উভয়কেই মোকাবেলা করা যায়। চারপাশের খাল ও নদীর নিকটতা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার কাজ করতো।
গল্প-গাথায় শোনা যায় গোপন ভূগর্ভস্থ পথ, গুপ্তধন ও লুণ্ঠনের চেষ্টা করলে অভিশাপের কথাও — যা মহাস্থানগড়ের রহস্যময়তাকে আরও গভীর করে তোলে।
মিথ ও সাহিত্যিক বর্ণনায় মহাস্থানগড়
পুরাণ ও লোককাহিনী মহাস্থানগড়ের আকর্ষণকে আরও বাড়িয়েছে। এটি বেহুলা-লখিন্দর এর করুণ প্রেমকাহিনীর সাথে জড়িত, যা বাংলার সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। কোনো কোনো ব্যাখ্যা মতে, বেহুলার ধনকুবের শ্বশুর চাঁদ সওদাগরের প্রাসাদ এখানেই ছিল।
প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত-এও পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ একটি প্রধান নগরী হিসেবে করা হয়েছে। ইতিহাস ও মিথের এ মেলবন্ধন অফুরন্ত কৌতূহল ও কল্পনার খোরাক যোগায়।
বৌদ্ধ থেকে ইসলাম: বিশ্বাসের ধারাবাহিকতা
মহাস্থানগড়ের দীর্ঘ ইতিহাসে বাংলার ধর্মীয় বিবর্তনেরও চিত্র পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় এটি একসময় বৌদ্ধ ধর্মের কেন্দ্র ছিল, স্তূপ ও বৌদ্ধ মূর্তিগুলো তার প্রমাণ। পরে পাল ও সেন যুগে হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটে, মন্দির ও দেবমূর্তিগুলো তা দেখায়।
মুসলিম শাসকরা বাংলায় আসার পর মসজিদ ও সমাধি গড়ে ওঠে চারপাশে। এর মধ্যে অন্যতম হলো শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার এর মাজার, যেখানে বিশ্বাস করা হয় এক সুফি দরবেশ বলখ (আফগানিস্তান) থেকে আকাশপথে ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলেন। এ স্থান আজও ভক্ত ও দর্শনার্থীদের টানে, যা বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ।
আজকের মহাস্থানগড় সফর
বর্তমান দর্শনার্থীরা মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও ছোট হলেও আকর্ষণীয় মহাস্থানগড় জাদুঘর উভয়ই দেখতে পারেন। এখানে খননকৃত অনেক মূর্তি, মুদ্রা, টেরাকোটা ফলক সংরক্ষিত আছে।
দূর্গপ্রাচীরের ভিতর হেঁটে গেলে মনে হয় কোনো প্রাচীন কালে হাঁটছেন — চারপাশে ব্যস্ত বাজার, দূর-দূরান্তের বণিকেরা, মন্দিরে আয়োজিত বর্ণিল উৎসব যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। করতোয়ার স্রোত ও সবুজ মাঠ এ প্রাচীন দূর্গকে করে তোলে আরো নৈসর্গিক।
স্থানীয় গাইডরা ইতিহাসের তথ্যের সাথে সাথে স্থানীয় কিংবদন্তিও বলেন, যা অভিজ্ঞতাকে করে আরও জীবন্ত ও স্মরণীয়।
সংরক্ষণের গুরুত্ব
মহাস্থানগড় কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়; এটি বাংলাদেশের প্রাচীন পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ এবং জনগণের গর্বের উৎস। কিন্তু অন্যান্য অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থানের মতো এটি ক্ষয়, দখল ও পর্যাপ্ত সংরক্ষণ অর্থের অভাবে হুমকির মুখে।
বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ইউনেস্কো ও গবেষকদের প্রচেষ্টা এ অমূল্য ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য অব্যাহত রয়েছে। তবে স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের সচেতনতা আরও বাড়ানো দরকার যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মহাস্থানগড় অক্ষত থাকে।
উপসংহার: অতীতের প্রতিধ্বনি
মহাস্থানগড় আজও শত শত বছরের মানব কীর্তির নীরব প্রহরী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ইতিহাস, কিংবদন্তি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একাকার হয়েছে। এই প্রাচীন স্থানে ভ্রমণ কেবল ধ্বংসাবশেষ দেখা নয়, বরং বাংলার সভ্যতার মূলের সাথে গভীর সংযোগ স্থাপন।
আপনি যদি ইতিহাসপ্রেমী হন, গল্পের খোঁজে থাকেন বা শুধু অতীতের রহস্যে আকৃষ্ট হন, মহাস্থানগড় এক ঝলক দেখিয়ে দেয় এমন এক জগৎ যা অসংখ্য অদেখা পথে আমাদের বর্তমানকে গড়ে তুলেছে। এটি আমাদের থমকে দাঁড়াতে, ভাবতে ও সময়ের স্রোতের প্রতি বিস্মিত হতে আহ্বান জানায় — মনে করিয়ে দেয়, সাম্রাজ্য হয়তো ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু তাদের গল্প মাটির গভীরে চিরকাল বেঁচে থাকে।
Comments
Post a Comment