Skip to main content

#পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার


পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার: বাংলার গৌরবময় অতীতের সাক্ষী

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার এক নির্জন গ্রামে অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, যা প্রাচীনকালে পরিচিত ছিল সমপুর মহাবিহার নামে। এটি কেবল বাংলাদেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ এবং সমৃদ্ধ বৌদ্ধ বিহার। এর স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস ও শিল্পকর্ম প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য ধন।

ইতিহাসের পাতা থেকে

সমপুর মহাবিহার নির্মাণ করেছিলেন পাল রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট ধর্মপাল (প্রায় ৮১০ খ্রিঃ)। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পরম পৃষ্ঠপোষক। তাদের শাসনামলে (৮ম থেকে ১২শ শতক) বাংলা হয়ে উঠেছিল মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেই সময়ে সমপুর মহাবিহার ছিল কেবল উপাসনার স্থান নয়, বরং একটি মহাবিদ্যাপীঠ, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো ভিক্ষু, পণ্ডিত ও ছাত্র এসে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা ও শিল্পকলার শিক্ষা গ্রহণ করতেন।

চীনা পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের রচনায়, তিব্বতের প্রাচীন দলিল এবং নানা সূত্রে জানা যায়, সমপুর মহাবিহার ছিল নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের পরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র।

অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তার বিশাল স্থাপত্য কাঠামো। প্রায় ২৭ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই কমপ্লেক্স চতুর্ভুজাকৃতির। চারপাশে লম্বা প্রাচীর, যার ভেতরের দিকে ছিল প্রায় ১৭৭টি মঠকক্ষ। এগুলোতে ভিক্ষুরা বাস করতেন, ধ্যান-ধ্যান করতেন ও শাস্ত্র পাঠ করতেন।

বিহারের মাঝখানে রয়েছে একটি বিশাল ক্রুশাকার স্তূপমন্দির। এটি ত্রিস্তর বিশিষ্ট উঁচু টেরেসের উপর নির্মিত। প্রাথমিক অবস্থায় এর উচ্চতা প্রায় ৭০ ফুটেরও বেশি ছিল বলে অনুমান। স্তূপের গায়ে অসংখ্য টেরাকোটা ফলক বসানো, যেখানে নানা ধর্মীয় কাহিনী, দৈনন্দিন জীবন, নৃত্য-সঙ্গীত, পশুপাখি ও পৌরাণিক চরিত্রের চিত্র অঙ্কিত। এগুলো আমাদের প্রাচীন বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনের এক অমূল্য দলিল।

স্থাপত্য কৌশল এমনভাবে পরিকল্পিত ছিল যাতে প্রখর গ্রীষ্মের তাপ সহনীয় হয়। মজবুত ইটের দেয়াল তাপ রোধ করত, খোলা প্রাঙ্গণ বাতাস চলাচল সহজ করত।

শিল্পকলা ও টেরাকোটার অপার সম্ভার

পাহাড়পুর বিহারের আরেকটি আশ্চর্য দিক হলো এর টেরাকোটা শিল্প। স্তূপ ও প্রাচীরের গায়ে বসানো হাজার হাজার মৃৎফলক প্রাচীন বাংলার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন।

এগুলিতে যেমন দেখা যায় জটিল ধর্মীয় প্রতীক ও বুদ্ধ জীবনের নানা উপাখ্যান, তেমনি দেখা যায় কৃষক, জেলে, নর্তকী, সঙ্গীতশিল্পী, শিকারি ও ব্যবসায়ীদের চিত্র। এ যেন এক চলমান প্রাচীন বাংলা। এগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা পাই সেই সময়ের পোশাক-পরিচ্ছদ, গৃহস্থালির সামগ্রী ও সামাজিক জীবনের স্পষ্ট ধারণা।

বিস্তার ও প্রভাব

সমপুর মহাবিহার শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এর স্থাপত্যরীতি পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু বৌদ্ধ স্থাপত্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মায়ানমার, জাভা (ইন্দোনেশিয়া) ও কম্বোডিয়ার অঙ্গকরের কিছু স্থাপত্যে সমপুরের ডিজাইনের অনুরূপতা পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন বাংলার এই বিহার কেবল ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক সংযোগেরও অন্যতম সেতুবন্ধ ছিল।

পতন ও বিস্মৃতির গহ্বরে

প্রায় ৪০০ বছর ধরে সমপুর মহাবিহার ছিল পূর্ণযৌবনা। কিন্তু ১২শ শতকের পর পাল সাম্রাজ্যের পতন, মুসলিম শাসনের সূচনা এবং বৌদ্ধ ধর্মের ক্রমশ অবলুপ্তির ফলে এই মহাবিহার তার প্রভাব হারাতে শুরু করে। একসময় তা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়। কালক্রমে গাছ-লতা-গুল্মে ঢেকে যায় সমপুর মহাবিহার। স্থানীয়রা এই উঁচু ঢিবিকে পাহাড় ভেবে নাম দেয় “পাহাড়পুর”

আধুনিক আবিষ্কার

১৮১৫ সালে প্রথম ব্রিটিশ জরিপকারী বুকানন হ্যামিল্টন পাহাড়পুরের কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে ১৯২৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ (ASI) এখানে বিস্তৃত খননকাজ চালিয়ে সমপুর মহাবিহারকে আবার বিশ্বের সামনে হাজির করে।

খননের সময় এখানে পাওয়া যায় অসংখ্য প্রত্নবস্তু — টেরাকোটা ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পোড়ামাটির পাত্র, শিলালিপি, মুদ্রা প্রভৃতি। এগুলো পাহাড়পুর সংরক্ষণাগারে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয়।

আজকের পাহাড়পুর

১৯৮৫ সালে UNESCO পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে “বিশ্ব ঐতিহ্য (World Heritage Site)” এর মর্যাদা প্রদান করে। বর্তমানে এখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষক আসেন।

বাংলাদেশ সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই মহাবিহারকে সংরক্ষণে নিয়মিত কাজ করছে। এছাড়া এখানে একটি সুন্দর সাইট মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে খননকালে উদ্ধার হওয়া দ্রব্যাদি সুন্দরভাবে প্রদর্শিত।

পর্যটকদের জন্য কিছু পরামর্শ

  • পাহাড়পুর ঘুরতে সবচেয়ে ভালো সময় হলো নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, যখন আবহাওয়া শীতল ও আরামদায়ক।

  • পুরো বিহার পরিদর্শনে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা সময় রাখুন। বিশাল এলাকা, স্তূপ, কক্ষ ও টেরাকোটা গুলি ধীরে ধীরে ঘুরে দেখলে তবেই তার সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায়।

  • সাথে পাহাড়পুর জাদুঘরও দেখুন, তাহলে এখানে খুঁজে পাওয়া শিল্পকলা ও ইতিহাস আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।

  • চাইলে একদিনে পাহাড়পুর এবং নিকটবর্তী মহাস্থানগড় (প্রাচীন পুণ্ড্রনগর) একসাথে ঘুরে দেখতে পারেন, এতে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস আরও সমৃদ্ধভাবে অনুভব করা যায়।

উপসংহার

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার শুধুমাত্র ইট-টেরাকোটা দিয়ে গড়া এক প্রাচীন অবকাঠামো নয়, এটি বাংলার প্রাচীন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার এক অমর স্মারক। আজও এর প্রতিটি ফলকে লুকিয়ে আছে সেই দিনের গল্প, যখন এখানে হাজারো ছাত্র-ভিক্ষু সমবেত হতেন, তর্ক-আলোচনায় মাততেন, শিল্পীরা মাটিকে রূপ দিতেন চিরন্তন সৌন্দর্যে।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অতীতকে জানা মানে নিজের শিকড়কে জানা। পাহাড়পুর তাই প্রতিটি বাঙালির জন্য গর্বের বিষয় — যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির আভিজাত্য অনুভব করতে পারি।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...