ভারত ছাড়ো আন্দোলন: ভারতের স্বাধীনতার পথে এক নির্ণায়ক অধ্যায়
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট’ একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের সর্বাত্মক অভ্যুত্থান, যা ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয় যে, ভারত আর বেশি দিন তাদের শাসন সহ্য করবে না।
এটি নেতৃত্ব দেন মহাত্মা গান্ধী, যিনি ‘করো বা মরো (Do or Die)’ স্লোগানের মাধ্যমে সমগ্র ভারতবাসীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। চলুন এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো ও এর নেতৃত্ব নিয়ে বিস্তারিত জানি।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পটভূমি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতের কোনো মতামত না নিয়েই ভারতকে যুদ্ধে যুক্ত করে। এতে ভারতীয়দের মধ্যে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ব্রিটেন ক্রিপস মিশন প্রেরণ করে, যা ভারতের জন্য যুদ্ধ-পরবর্তী স্বায়ত্তশাসনের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়। কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষত মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ নেতারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের মানুষ তখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়—এখন আর ধৈর্য নয়, স্বাধীনতা চাই অবিলম্বে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. তাৎক্ষণিক স্বাধীনতার দাবি
এই আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি ধাপে ধাপে শাসন হস্তান্তরের প্রস্তাব নয়, বরং ব্রিটিশদের অবিলম্বে ভারত ছাড়ার দাবি। কংগ্রেস পরিষদে ৮ আগস্ট ১৯৪২ সালে পাস হওয়া প্রস্তাবে সাফ বলা হয়, ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে ভারত ত্যাগ করতে হবে।
২. ‘করো বা মরো’ স্লোগান
৮ আগস্ট বোম্বের গওয়ালিয়া ট্যাংক ময়দানে কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিখ্যাত ভাষণে বলেন,
"আমরা স্বাধীনতা অর্জন করব বা এই প্রচেষ্টায় প্রাণ দেব। করো বা মরো।"
এই স্লোগান সমগ্র জাতিকে একতাবদ্ধ করে তোলে।
৩. সার্বজনীন অংশগ্রহণ
এই আন্দোলনে কেবল রাজনৈতিক নেতা ও কংগ্রেস কর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, এমনকি বহু মহিলা পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এটি সত্যিকার অর্থে গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়।
৪. বিস্তৃত অসহযোগ ও সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স
গান্ধী জনগণকে ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। সরকারী অফিস, আদালত, রেল, ডাক-তার সবখানেই বিক্ষোভ শুরু হয়। কর না দেওয়া, চাকরি ছেড়ে দেওয়া, স্কুল-কলেজ বর্জন, ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসন প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
৫. বিকেন্দ্রীকৃত ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন
ব্রিটিশ সরকার প্রাথমিক অবস্থাতেই গান্ধী, নেহরু, প্যাটেল, মৌলানা আজাদসহ সমস্ত শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে। ফলে নেতৃত্ব স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় নেতারা, এমনকি সাধারণ মানুষও নিজ উদ্যোগে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
৬. গোপন আন্দোলন ও অ地下প্রচার
নেতারা গোপনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। গোপন প্রেস, লিফলেট, বিপ্লবী বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য গোপন চ্যানেল তৈরি হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, অরুণা আসফ আলী প্রমুখ এই গোপন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন।
৭. সমান্তরাল সরকার (Parallel Government)
কিছু অঞ্চলে জনগণ নিজেরাই স্থানীয় প্রশাসন চালাতে শুরু করে। যেমন, উত্তর প্রদেশের বলিয়া, বাংলার তমলুক জাতীয় সরকার, মহারাষ্ট্রের সাতারা প্রভৃতি স্থানে। এরা ব্রিটিশ প্রশাসনকে কার্যত উৎখাত করে স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করে।
৮. ব্রিটিশদের দমন-পীড়ন
ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমাতে সেনাবাহিনী নামায়, জরুরি অবস্থা জারি করে, গণগ্রেফতার ও গুলি চালায়। প্রায় ১ লাখের বেশি মানুষ গ্রেফতার হন। বহু মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
আন্দোলনের নেতৃত্ব
মহাত্মা গান্ধী
এই আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনিই কংগ্রেসকে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নৈতিক কর্তৃত্ব, অহিংসা ও সত্যাগ্রহের দর্শন গোটা আন্দোলনকে গঠন করে।
জওহরলাল নেহরু ও সরদার প্যাটেল
গান্ধীর পরপরই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন জওহরলাল নেহরু, সরদার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ, রাজেন্দ্র প্রসাদ প্রমুখ কংগ্রেস নেতা। যদিও তাদের দ্রুত গ্রেফতার করা হয়, তবুও তাদের উপস্থিতি জনগণকে প্রেরণা জুগিয়ে যায়।
দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব ও স্থানীয় নেতারা
শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পর আন্দোলন চালিয়ে যান জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, অরুণা আসফ আলী, যিনি বোম্বেতে তেরঙা উত্তোলন করেন। তাঁরা গোপন থেকে আন্দোলন চালান এবং সারা দেশে বিপ্লবী সজাগতা সৃষ্টি করেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রভাব ও গুরুত্ব
১. ব্রিটিশ শাসনের উপর চূড়ান্ত চাপ:
এই আন্দোলন ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দেয়, ভারতের ওপর তাদের শাসন আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
২. ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় সংহতি:
সমস্ত ধর্ম, জাতি ও পেশার মানুষ এই আন্দোলনে একজোট হয়, যা স্বাধীনতার জন্য ভারতের চূড়ান্ত প্রস্তুতিকে মজবুত করে।
৩. পরবর্তীতে স্বাধীনতার রাস্তা প্রসারিত:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেন আর ভারত শাসন চালিয়ে যাওয়ার অবস্থায় ছিল না। এই আন্দোলনই সেই পরবর্তী সংলাপ ও ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি করে।
উপসংহার
ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতের মানুষের একটি ‘অবাধ্যতার চূড়ান্ত ঘোষণা’। এর মাধ্যমে গোটা দেশ এক কণ্ঠে বলে ওঠে—আর নয়, এখনই স্বাধীনতা চাই। গান্ধীর ‘করো বা মরো’ ডাক এবং লক্ষ লক্ষ অজানা মানুষের সাহসী অংশগ্রহণ ভারতকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়।
এটি ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, কিভাবে একটি নিপীড়িত জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অহিংস উপায়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে।
Comments
Post a Comment