Skip to main content

#আফগানিস্তান কেন পরাশক্তিদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে?


আফগানিস্তান কেন পরাশক্তিদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে? — একটি ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণ

আফগানিস্তান — পাহাড়ে ঘেরা, খনিজ সম্পদে ভরপুর কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। ইতিহাসের পাতায় আফগানিস্তানের নাম বারবার উঠে এসেছে পরাশক্তিদের আগ্রাসনের কারণে। ১৯শ শতকের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ২০শ শতকের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ২১শ শতকের যুক্তরাষ্ট্র — সবাই কোন না কোন সময় আফগানিস্তানে আক্রমণ চালিয়েছে বা সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? কেন আফগানিস্তান বারবার পরাশক্তিদের টার্গেটে পরিণত হয়?

কৌশলগত অবস্থান: আফগানিস্তানের মূল অভিশাপ

সবচেয়ে বড় কারণ হলো আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান। এটি এশিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত, যা একে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থলে পরিণত করেছে। এর পূর্বে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং সামান্য উত্তর-পূর্বে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। এই অবস্থান একে সর্বদা একটি গুরুত্বপূর্ণ “কৌশলগত করিডোর” বা স্ট্র্যাটেজিক প্যাসেজে পরিণত করেছে।

১৯শ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানকে ঘিরে যে কূটনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্ব চলেছিল, ইতিহাসে তা “গ্রেট গেম” নামে পরিচিত। ব্রিটেন আশঙ্কা করত যে, রাশিয়া আফগানিস্তান হয়ে সরাসরি ভারতের দিকে অগ্রসর হবে। তাই ব্রিটিশরা আফগানিস্তানকে একটি বাফার স্টেট বানাতে চেয়েছিল। সেই কারণে তারা একের পর এক যুদ্ধ করে দেশটিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল। এর ফলে আফগানিস্তান এক ভয়াবহ রাজনৈতিক ও সামরিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

সোভিয়েত আগ্রাসন এবং ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়া

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। তখন আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চলছিল। সোভিয়েতরা তাদের মিত্র সরকারকে রক্ষার জন্য সরাসরি সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে। এর পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং সৌদি আরব মিলিতভাবে আফগান মুজাহিদিনদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। এইভাবে আফগানিস্তান ঠান্ডা যুদ্ধের একটি বড় প্রক্সি ওয়ার এর মঞ্চে পরিণত হয়।

দশ বছরের সেই যুদ্ধ আফগান সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। লাখ লাখ আফগান নিহত ও শরণার্থী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের মাধ্যমে কমিউনিজমের পতনের পথও তৈরি হয়, কিন্তু সেই সাথে উত্থান ঘটে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর। পরবর্তী সময়ে এরাই হয়ে ওঠে তালেবান ও আল-কায়েদার ভিত্তি।

৯/১১ এর পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তান আবারও পরাশক্তির নজরে আসে। কারণ এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ওসামা বিন লাদেন এবং আল-কায়েদা নেতৃত্ব তখন আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের আশ্রয়ে অবস্থান করছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে ক্ষমতা থেকে হটানোর অজুহাতে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়।

প্রাথমিকভাবে তালেবান সরকার খুব সহজেই উৎখাত হয়। কিন্তু এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেখানে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে “রাষ্ট্র নির্মাণ” বা নেশন বিল্ডিং প্রকল্প চালায়। এই প্রক্রিয়ায় লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ হয়, অনেক আন্তর্জাতিক সৈন্য নিহত হয়, এবং আফগানিস্তান আরও জটিল এক সংঘাতের দিকে চলে যায়।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। এতে বোঝা যায়, বহিরাগত হস্তক্ষেপ আফগান সমাজের জটিল বাস্তবতা বুঝতে না পারলে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই হয়।

খনিজ সম্পদের লোভ

অনেকেই মনে করেন আফগানিস্তান শুধুই একটি কৌশলগত অবস্থান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আফগানিস্তান খনিজ সম্পদে ভরপুর। বিশ্বব্যাপী লিথিয়াম, তামা, লোহা, সোনা এবং দামী রত্নের যে চাহিদা — তার বিপুল সম্ভার আফগানিস্তানে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটির মাটির নিচে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের খনিজ সম্পদ রয়েছে।

বিশেষ করে লিথিয়াম — যা ব্যাটারি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ — সেটি আফগানিস্তানকে “লিথিয়ামের সৌদি আরব” বলেও উপাধি দিয়েছে অনেকে। ফলে বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদে এই সম্পদ লুটে নেওয়ার লক্ষ্যও রাখে।

আধুনিক যুগেও বাফার স্টেট

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও আফগানিস্তানকে ঘিরে পরাশক্তিদের কৌশল বদলায়নি। রাশিয়া চায় মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে। চীন চায় এর মাধ্যমে শিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবাদর্শ দমনে সাহায্য পেতে। পাকিস্তান চায় আফগানিস্তানকে ভারতের প্রভাবমুক্ত রাখতে এবং নিজেদের “স্ট্র্যাটেজিক ডেপথ” হিসেবে ব্যবহার করতে। অপরদিকে ভারত চায় আফগানিস্তানে বিনিয়োগের মাধ্যমে পাকিস্তানকে চাপে রাখতে।

এইভাবে আফগানিস্তান এখনও একটি বড় আঞ্চলিক পাওয়ার প্লে-এর অংশ।

সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাত

পরাশক্তিরা প্রায়ই আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের জন্য “সন্ত্রাসবাদ দমন” এর যুক্তি দেয়। সোভিয়েতরা বলেছিল কমিউনিজম রক্ষার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আল-কায়েদা ধ্বংস ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের সামরিক অভিযান প্রায়শই নতুন উগ্রপন্থার জন্ম দেয়। সোভিয়েত যুদ্ধের পর যে মুজাহিদিন তৈরি হয়েছিল, তারাই তালেবান ও আল-কায়েদার ভিত্তি। আর ২০০১ সালের যুদ্ধের পর জন্ম নেয় আরও নতুন চরমপন্থী গোষ্ঠী।

আফগান জনগণের অবর্ণনীয় দুর্দশা

সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই সব কৌশলগত খেলার চরম মূল্য দিতে হয়েছে আফগান জনগণকেই। যুগে যুগে তারা শরণার্থী, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, গৃহহীনতা, এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। পরাশক্তিদের স্বার্থের খেলা শেষে তারা রেখে গেছে ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধাহত শিশু এবং অসংখ্য কবর।

উপসংহার: ইতিহাস থেকে শিক্ষা

আফগানিস্তানের ইতিহাস আমাদের একটি কঠিন শিক্ষা দেয়। ছোট একটি দেশ, যা ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি প্রায়শই পরাশক্তিদের হাতে খেলনার মতো ব্যবহার হয়। বড় বড় কৌশলগত স্বপ্ন, সন্ত্রাসবাদ দমন বা খনিজ লোভের গল্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সেই সাধারণ আফগানদের — যাদের শান্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা আর স্বাভাবিক জীবনের অধিকার প্রায়শই বিলাসিতায় পরিণত হয়।

বিশ্ব যদি সত্যিই আফগানিস্তানকে সহায়তা করতে চায়, তবে প্রথমে আফগান জনগণের নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা, সংস্কৃতি ও অধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। নাহলে আফগানিস্তান সেই পুরনো পরাশক্তির খেলার ময়দান হয়েই থেকে যাবে, আর তার মানুষগুলো অবিরাম দুঃখের গল্পের অংশ হয়ে যাবে।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...