যোদ্ধা রানিরা: ভারতে সাহসী নারীদের শাসনের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস
ভারতের ইতিহাস বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং নেতৃত্বের গল্পে পূর্ণ। কিন্তু এ ইতিহাসে অনেকসময় ঢাকা পড়ে যায় সেই সাহসী নারীদের কাহিনি, যারা পুরুষ-প্রধান সমাজে ক্ষমতার দাবি জানিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এ নারীরা শুধু নিজের সিংহাসন বা রাজ্য রক্ষাই করেননি—তারা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও লড়েছেন, সেনা নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে নতুন দিক তৈরি করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব ভারতের ইতিহাসের সেই সাহসী নারীদের কথা, যাঁদের সংগ্রাম আজও প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা দেয়।
১. রাযা সুলতানা: দিল্লির প্রথম নারী শাসক
১৩শ শতাব্দীতে দিল্লি সালতানাতের সময় রাযা সুলতানা হন দিল্লির একমাত্র নারী সুলতান। তাঁর পিতা ইলতুৎমিশ তাঁকে তাঁর ভাইদের পরিবর্তে উত্তরাধিকারী করেন বুদ্ধিমত্তা ও প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য। কিন্তু রাযার শাসন শুরুর আগেই পুরুষ শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়।
সেই বিরোধিতা সত্ত্বেও, তিনি পুরুষের পোশাকে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা নেতৃত্ব দেন এবং ন্যায্যতা ও কঠোরতায় শাসন করেন। ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসন conspiracies এর কারণে শেষ হয়, কিন্তু লিঙ্গভেদকে অস্বীকার করার তাঁর সাহসী প্রচেষ্টা ইতিহাসে একটি শক্তিশালী ছাপ রেখে গেছে।
২. রানী দুর্গাবতী: গন্ডওয়ানার যোদ্ধা রানী
১৬শ শতকে মধ্য ভারতের গন্ডওয়ানায় শাসন করেন রানী দুর্গাবতী। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি তাঁর শিশুপুত্রের হয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন এবং শীঘ্রই বীরত্ব ও কৌশলের জন্য প্রসিদ্ধ হন।
১৫৬৪ সালে আকবরের সেনাপতি আসফ খান গন্ডওয়ানায় আক্রমণ করলে রানী দুর্গাবতী আত্মসমর্পণ না করে যুদ্ধের ময়দানে নামেন। তিনি সংখ্যায় ও অস্ত্রে দুর্বল হলেও প্রবল প্রতিরোধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করেন। তাঁর আত্মত্যাগ সম্মান ও সাহসের প্রতীক হিসেবে চিরস্মরণীয়।
৩. ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই: ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের প্রতীক
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সুপরিচিত চরিত্র ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় তিনি ঝাঁসির রানি হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন "Doctrine of Lapse" নীতিতে তাঁর রাজ্য দখলের চেষ্টা করে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি—"আমি আমার ঝাঁসি দেব না"—আজও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে তিনি পুরুষ বেশে যুদ্ধ করেন এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে শহিদ হন। তাঁর সংগ্রাম কেবল ঝাঁসির জন্য নয়—ভারতের স্বাধীনতা এবং নারীর নেতৃত্বের অধিকারের জন্যও ছিল।
৪. বেগম হাজরত মহল: আওধের বিদ্রোহী রানী
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় উত্তর ভারতের আওধে নেতৃত্ব দেন বেগম হাজরত মহল। ব্রিটিশরা আওধ দখল করে তাঁর স্বামী নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে নির্বাসনে পাঠালে, তিনি লখনৌতে কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বিদ্রোহে যোগ দেন।
তিনি লখনৌ দখল করে তাঁর পুত্রকে নবাব ঘোষণা করেন। শেষপর্যন্ত পরাজিত হলেও, যুদ্ধকালে তাঁর সাহসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা তাঁকে একজন শক্তিশালী নেত্রী হিসেবে প্রতিপন্ন করে। তিনি পরে নেপালে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই নির্বাসনে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতিরোধ ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয়।
৫. কিত্তূর রানী চেন্নাম্মা: দক্ষিণ ভারতের প্রতিরোধের পথিকৃৎ
১৮৫৭ সালের বহু আগে ১৮২৪ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম অস্ত্র ধরেন কর্ণাটকের কিত্তূর রাজ্যের রানী চেন্নাম্মা। তাঁর পালিত পুত্রকে ব্রিটিশরা রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে মানতে অস্বীকার করলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
প্রথম দিকে কিছুটা সফল হলেও পরে তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারারুদ্ধ রাখা হয়। তাঁর বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. ভেলু নাচিয়ার: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রথম ভারতীয় রানী
ভেলু নাচিয়ার তামিলনাড়ুর শিবগঙ্গা রাজ্যের রানী ছিলেন এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা প্রথম ভারতীয় রানী। ১৭৮০ সালে ব্রিটিশদের হাতে স্বামী নিহত হলে তিনি নির্বাসনে যান, সেনা জোগাড় করেন এবং নারীদের সঙ্গেও একটি বাহিনী গঠন করেন।
তাঁর সেনানায়িকা কুইলি একটি আত্মঘাতী হামলায় ব্রিটিশ অস্ত্রাগার ধ্বংস করেন—ভারতের ইতিহাসে প্রথম আত্মঘাতী আক্রমণের ঘটনা। ভেলু নাচিয়ার আবার সিংহাসনে ফিরে এসে এক দশক শাসন করেন। ইতিহাস তাঁকে অনেকটা ভুলে গেলেও, তাঁর নেতৃত্ব ও কৌশল তাঁকে একজন শক্তিশালী নারী হিসেবে তুলে ধরে।
৭. রানী অবন্তীবাই লোধি: স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা এক আদিবাসী রানী
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে আরও এক অনালোকিত চরিত্র রানী অবন্তীবাই লোধি। মধ্যপ্রদেশের রামগড় রাজ্যের রানী হিসেবে, স্বামীর মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা যখন রাজ্য দখল করতে চায়, তিনি ৪,০০০ সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেন।
যুদ্ধে পরাজয়ের সম্ভাবনা দেখে তিনি আত্মসমর্পণের বদলে নিজের তরবারি দিয়ে আত্মাহুতি দেন। তাঁর সাহসিকতা তাঁকে ভারতের বিস্মৃত নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাতারে স্থাপন করেছে।
এই নারীদের শাসনের পথে বাধা
ভারতের সাহসী নারী শাসকরা বহুস্তর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন:
-
পিতৃতন্ত্র: লিঙ্গের কারণে তারা বারবার সন্দেহ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হন
-
অন্তঃকোন্দল: অনেক সময় প্রভাবশালী সভাসদরাই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন
-
বহিরাক্রমণ: তাদের শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, মুঘল এবং ব্রিটিশ শক্তিরও মোকাবিলা করতে হয়
-
ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা: তাদের অবদান অনেক সময় সরকারি ইতিহাসে অবমূল্যায়িত হয়েছে বা অবহেলিত হয়েছে
তবুও, সব প্রতিকূলতাকে জয় করে তাঁরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।
ঐতিহ্য ও অনুপ্রেরণা
এই নারীরা কেবল ইতিহাসের চরিত্র নন—তাঁরা দৃঢ়তা, সাহস ও নেতৃত্বের প্রতীক। তাঁদের জীবন প্রমাণ করে নেতৃত্বের অধিকার কোনও লিঙ্গনির্ভর নয়। আজ তাঁদের নাম স্মরণে রয়েছে ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ এবং সামরিক পদকে।
বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই, চলচ্চিত্র ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও তাঁদের গল্প নতুনভাবে জীবন্ত হচ্ছে—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই সংগ্রামের সম্পূর্ণ চিত্র উপলব্ধি করতে পারে।
উপসংহার
ভারতের নারী শাসক ও যোদ্ধাদের ইতিহাস গভীর, জটিল এবং অত্যন্ত অনুপ্রেরণামূলক। দিল্লির দুর্গ থেকে শুরু করে তামিলনাড়ুর মন্দির পর্যন্ত সাহসী নারীরা নিজেদের অস্তিত্বের ছাপ রেখে গেছেন—তাদের হাতে ছিল তরবারি, মনে ছিল আগুন।
তাঁরা শুধু শাসনের জন্য সংগ্রাম করেননি—তাঁরা নেতৃত্বের অধিকার, প্রতিরোধের অধিকার এবং স্বপ্ন দেখার অধিকার আদায়ের জন্য লড়েছেন। তাঁদের উত্তরাধিকার প্রমাণ করে—সাহস কখনও লিঙ্গভিত্তিক নয়, এবং ন্যায়ের জন্য সংগ্রামের কোনও সীমা নেই।
Comments
Post a Comment