Skip to main content

#আফগানিস্তান কখন স্বাধীনতা লাভ করে এবং যুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপ্তি।

আফগানিস্তান: স্বাধীনতা ও দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস

আফগানিস্তান — এক পাহাড়ি, শুষ্ক ও কঠিন ভূখণ্ডের দেশ, যা হাজার হাজার বছর ধরে ভিন্ন ভিন্ন সাম্রাজ্য, আক্রমণকারী এবং রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই দেশের ইতিহাসের মূল সুর যেন যুদ্ধ, প্রতিরোধ ও টিকে থাকার কাহিনি। আফগানরা বহুবার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে, এবং এভাবে গড়ে উঠেছে তাদের জাতীয় পরিচয় ও গৌরব।

আফগানিস্তান কখন স্বাধীনতা লাভ করে?

আধুনিক অর্থে আফগানিস্তান ১৯১৯ সালের ১৯ আগস্ট তারিখে স্বাধীনতা লাভ করে। এই দিনটিকে আফগানরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপন করে।

স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রধান ঘটনা হলো তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ। ১৯ শতকজুড়ে আফগানিস্তান ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘গ্রেট গেম’-এর প্রধান মঞ্চ। বৃটিশরা তাদের ভারতীয় উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যের জন্য আফগানিস্তানকে একটি বাফার স্টেট (সীমানারাজ্য) হিসেবে রাখতে চেয়েছিল। তাই দুই দফা বড় যুদ্ধ (প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ: ১৮৩৯–৪২, এবং দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ: ১৮৭৮–৮০) এর মাধ্যমে আফগানিস্তানকে চাপের মধ্যে রাখে।

ফলে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি অনেকাংশে বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

কিন্তু আমানুল্লাহ খান ১৯১৯ সালে সিংহাসনে বসেই এই নিয়ন্ত্রণ ভাঙার জন্য উদ্যোগী হন। তিনি বৃটিশ ভারতের সীমান্তে আক্রমণ চালান, যা তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ সৃষ্টি করে। যুদ্ধটি মাত্র কয়েক মাস স্থায়ী হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃটিশরা রাওয়ালপিন্ডি চুক্তি (১৯১৯) স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়, যেখানে তারা আফগানিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার অধিকার স্বীকার করে।

এর মধ্য দিয়েই আফগানিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

যুদ্ধের ইতিহাসের ব্যাপ্তি: প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান

আফগানিস্তানের ইতিহাসে যুদ্ধের ছাপ খুব গভীর। এটি প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে চলমান।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের আক্রমণ

  • খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ–৪র্থ শতাব্দী: আফগানিস্তান ছিল আচেমেনিদ পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ।

  • খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে: আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য জয় করে ভারত অভিযানের পথে আফগানিস্তান অতিক্রম করেন। তার সেনারা এখানে কয়েকটি শহর স্থাপন করে (যেমন কন্দহার — প্রাচীন ‘আলেকজান্দ্রিয়া আরাকোসিয়া’)।

  • ৭ম শতাব্দী থেকে: ইসলামি খিলাফত বাহিনী এ অঞ্চল দখল করে নেয়। পরবর্তী কয়েকশ বছর এখানে গজনভী, গুরিদ প্রভৃতি মুসলিম রাজবংশ রাজত্ব করে। আফগানিস্তান হয়ে ওঠে ইসলামি সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র।

  • ১৩শ শতাব্দীতে: চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল বাহিনী আফগানিস্তানকে ধ্বংস করে। পরবর্তীতে তেমুর (তিমুর লঙ) এই অঞ্চল থেকে তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন।

বৃটিশ যুগ ও ‘গ্রেট গেম’

  • ১৯ শতকে: আফগানিস্তান বৃটিশ ও রাশিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক কৌশলের প্রধান মঞ্চে পরিণত হয়।

  • প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৯–৪২): বৃটিশরা এখানে তাদের পছন্দের রাজা বসাতে এসে আফগানদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ১৮৪২ সালে কাবুল থেকে পশ্চাদপসরণকালে প্রায় পুরো বৃটিশ বাহিনী ধ্বংস হয়।

  • দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ (১৮৭৮–৮০): বৃটিশরা পুনরায় আফগানিস্তান আক্রমণ করে। যুদ্ধের পর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ শাসন রক্ষা পেলেও পররাষ্ট্রনীতি বৃটিশদের হাতে চলে যায়।

  • তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ (১৯১৯): আফগানরা পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়।

সোভিয়েত আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধ

  • ১৯৭৮ সালে: কমিউনিস্ট ‘সৌর বিপ্লব’-এর মাধ্যমে পিডিপিএ ক্ষমতায় আসে। তাদের সমাজতান্ত্রিক সংস্কার জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করে।

  • ১৯৭৯ সালে: সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে ও সরাসরি সৈন্য প্রেরণ করে। এর বিরুদ্ধে মুজাহিদিনরা জিহাদ শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও সৌদি আরব মুজাহিদিনদের অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে। প্রায় ১০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সোভিয়েত বাহিনী ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়।

  • ১৯৯২ সালে: কমিউনিস্ট সরকার পড়ে গেলে মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলি পরস্পরের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়।

তালেবান, আল-কায়েদা ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ

  • ১৯৯৬ সালে: তালেবান ক্ষমতা দখল করে। তারা কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ করে ও ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয়।

  • ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে আল-কায়েদার হামলার পর আমেরিকা ও ন্যাটো আফগানিস্তান আক্রমণ করে। তালেবান সরকার পতন ঘটে।

  • এরপর দুই দশকের যুদ্ধ চলতে থাকে। ২০২১ সালে আমেরিকার সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে।

কেন আফগানিস্তানে এত যুদ্ধ?

আফগানিস্তান ইতিহাস জুড়েই পরাশক্তিদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র। এর কয়েকটি মূল কারণ:

ভূগোল: কৌশলগত অবস্থান — মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থল।
পাহাড় ও গিরিখাত: আফগান জনগণকে বিচ্ছিন্ন ও উপজাতিগত ভিত্তিতে রাখে। শক্ত কোনো কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘকাল স্থিতি পায়নি।
বিদেশি হস্তক্ষেপ: বৃটিশ, রুশ, সোভিয়েত এবং আমেরিকা — সকলেই আফগান ভূখণ্ডকে তাদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে।
সামাজিক কাঠামো: গোষ্ঠী ও উপজাতি ভিত্তিক সমাজে পরস্পরের বিরোধ সহজেই সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়।

উপসংহার

আফগানিস্তান স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯১৯ সালে, কিন্তু তার ইতিহাসে যুদ্ধ যেন লেপ্টে আছে। প্রাচীন পারস্য, আলেকজান্ডার, মঙ্গোল, তেমুর থেকে বৃটিশ, সোভিয়েত, আমেরিকা পর্যন্ত — সবাই আফগানিস্তানে পা ফেলেছে, কিন্তু পুরোপুরি জয় করতে পারেনি।

এই জাতি বহু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে, তবু তাদের সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয় টিকে আছে। আফগানদের সংগ্রামের ইতিহাস একদিকে বেদনার, আবার অন্যদিকে অবিচল দৃঢ়তারও নিদর্শন। ভবিষ্যত হয়তো নতুন কোনো অধ্যায় আনবে, যেখানে এই দেশ শান্তি ও স্থিতির মুখ দেখবে।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...