কুরুশ দ্য গ্রেট: ইরানের ইতিহাসের মহান শাসক ও মানবতার দূত
ইতিহাসে এমন কিছু মহান শাসক রয়েছেন, যাঁরা কেবল যুদ্ধজয়ী বা সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যই স্মরণীয় নন, বরং তাঁদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, উদার নীতি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার জন্যও তাঁরা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকেন। ইরানের (প্রাচীন পারস্যের) কুরুশ দ্য গ্রেট (Cyrus the Great) ঠিক তেমনই একজন শাসক। খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা বিশ্বের প্রথম সুসংগঠিত ও বৈচিত্র্যময় সাম্রাজ্যগুলির একটি হিসাবে বিবেচিত হয়।
জন্ম ও শৈশব
কুরুশ দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫৭৬ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন, পারস্যের আনশান অঞ্চলে। তাঁর পিতা ছিলেন পারস্যের রাজা কম্বিজ I এবং মাতা ছিলেন মিডিয়ার রাজকন্যা। ছোটবেলা থেকেই কুরুশ বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলীর জন্য পরিচিত ছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের বিবরণে দেখা যায়, তাঁর জন্মের সময় মিডিয়ার রাজা আস্তিয়াগাস একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা থেকে ভয় পেয়ে কুরুশকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ভাগ্যের খেলায় কুরুশ বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে ইতিহাসের মঞ্চে তাঁর গৌরবময় আবির্ভাব ঘটে।
সাম্রাজ্য গঠন ও যুদ্ধজয়
কুরুশ দ্য গ্রেট প্রথমে পারস্যের আনশান রাজ্যের শাসক ছিলেন। ক্রমে তিনি মিডিয়া, লিডিয়া এবং ব্যাবিলনের মতো শক্তিশালী রাজ্যসমূহ দখল করে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ সালে মিডিয়ান সাম্রাজ্য জয় করার মাধ্যমে পারস্যের উত্থান শুরু হয়। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৭-৫৪৬ সালে তিনি লিডিয়ার সম্রাট ক্রোসাসকে পরাজিত করেন।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তাঁর ব্যাবিলন বিজয় (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯)। তিনি প্রায় রক্তপাতহীনভাবে ব্যাবিলন দখল করেন এবং সেখানকার জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক রীতিনীতিকে সম্মান দেখান। ব্যাবিলনের ইহুদি বন্দীদের তিনি মুক্তি দেন এবং তাঁদের নিজ দেশে ফিরে গিয়ে পুনরায় মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেন। এ কারণে তাঁকে বাইবেলে “প্রভুর অনুরক্ত মশীহ” হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে।
শাসন পদ্ধতি ও মানবতা
কুরুশ দ্য গ্রেট কেবল একজন জয়ী সম্রাটই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মানবদরদী শাসক। তিনি বহুজাতিক, বহু-ধর্মীয় সাম্রাজ্য শাসন করতেন অত্যন্ত উদার নীতিতে। তাঁর সময়ে পারস্য সাম্রাজ্যের প্রশাসন ছিল স্থানীয় শাসক ও জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি ‘সত্রাপি’ (satrapy) নামে প্রাদেশিক প্রশাসনিক পদ্ধতি চালু করেন, যা পরে বহু সাম্রাজ্য অনুসরণ করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কুরুশ সিলিন্ডার (Cyrus Cylinder)। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ব্যাবিলন দখলের পর মৃৎপাত্রে লেখা এই ঘোষণাপত্রকে অনেকেই বিশ্বের প্রাচীনতম মানবাধিকার সনদ বলে মনে করেন। এতে ধর্মীয় স্বাধীনতা, দাসমুক্তি এবং সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে, যা কুরুশের উদার মানসিকতার প্রমাণ বহন করে।
ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কুরুশ দ্য গ্রেট ছিলেন সাহসী, বিচক্ষণ ও উদার মনের শাসক। তাঁর সামরিক কৌশল যেমন অনন্য ছিল, তেমনি ছিল তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা। তিনি শত্রুর ওপর অমানবিক নির্যাতন করতেন না। বরং বিজিত জনগণের সংস্কৃতি ও ধর্মকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের আস্থা অর্জন করতেন। এর ফলে তাঁর সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন স্থিতিশীল ছিল।
গ্রিক ঐতিহাসিক জেনোফন ‘সাইরোপিডিয়া’ নামক গ্রন্থে কুরুশের জীবনকাহিনি ও রাজনৈতিক দর্শন বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ ছাড়া হেরোডোটাসের বর্ণনাতেও কুরুশের জীবনকাল ও শাসনকাল সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর শাসনের মডেল পরবর্তী হেলেনিস্টিক ও রোমান শাসকরাও অধ্যয়ন করেছেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫৩০ সালে কুরুশ দ্য গ্রেট এক অভিযানে নিহত হন বলে ধারণা করা হয়। মৃত্যুর পর তাঁকে পারস্যের পাসারগাদে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর সমাধি আজও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
কুরুশের মৃত্যু হলেও তাঁর গড়ে তোলা সাম্রাজ্য টিকে থাকে এবং তাঁর উত্তরসূরীরা এটিকে আরও সম্প্রসারিত করেন। দারায়ুস দ্য গ্রেট (Darius I) এবং ক্ষত্রিয় প্রথম জেরক্সিসের মতো শাসকরা তাঁর উত্তরাধিকারে পারস্য সাম্রাজ্যকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শক্তি হিসেবে গড়ে তোলেন।
উপসংহার
আজকের দুনিয়ায় যখন ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতা প্রায়শই দেখা যায়, তখন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কুরুশ দ্য গ্রেট আমাদের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান। একজন সাম্রাজ্যবাদী হওয়ার পরও তিনি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও মানবাধিকারের প্রতি যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন, তা আজও সমাদৃত।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে শক্তি ও ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার কেবল জয় নয়, মানুষের হৃদয়ও জয় করতে পারে। তাই কুরুশ দ্য গ্রেট কেবল ইরানের নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।
Comments
Post a Comment