Skip to main content

#এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় কত সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন?

 

এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় কত সৈন্য নিয়ে এসেছিলেন?

প্রেক্ষাপট

ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলিম শাসনের বিস্তার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির নাম অবধারিতভাবে উঠে আসে। তার দুঃসাহসিক অভিযান, বিশেষ করে বাংলা বিজয়, উপমহাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রকে আমূল বদলে দেয়। এই বিজয়ের অন্যতম বিস্ময়কর দিক হলো—তিনি কত স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে এ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

বখতিয়ার খিলজি ছিলেন আফগানিস্তানের গরিব খিলজি গোত্রের একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত যোদ্ধা। ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি ভারতে আসেন। প্রথমে দিল্লির দরবারে যোগ দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়ে পরে বিহারে চলে আসেন। সেখানে নিজের যোগ্যতা ও সামরিক দক্ষতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্থানীয় মুসলিম শাসকদের বিশ্বাস অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং বাংলা অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

কত সৈন্য নিয়ে বাংলা অভিযানে এসেছিলেন?

বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযান সম্পর্কে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো তার সৈন্যসংখ্যা। তৎকালীন মুসলিম ইতিহাসবিদ মিনহাজ-উস-সিরাজ তার গ্রন্থ “তাবকাত-ই-নাসিরি” তে উল্লেখ করেছেন, বখতিয়ার খিলজি যখন সেন রাজধানী নবদ্বীপ আক্রমণ করেন, তখন তার সাথে মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ার সৈন্য ছিল।

এটি শুনে অনেকেরই অবাক লাগতে পারে—মালদহ, নদীয়া, গৌড়ের মতো সমৃদ্ধ জনপদ ও শক্তিশালী রাজধানী দখল করতে মাত্র ১৮ জন সৈন্য! তবে এ তথ্যটি মূলত একটি প্রতীকী উপস্থাপনা, যা বখতিয়ারের অভিযান যে কতোটা দুঃসাহসিক ও আচমকা ছিল তা বোঝাতে ইতিহাসে বারবার বলা হয়।

প্রকৃত সৈন্যসংখ্যা নিয়ে মতভেদ

মধ্যযুগের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য হলো, সে সময়কার অনেক বর্ণনা অতিরঞ্জন ও কাহিনীমূলক উপাদানে ভরপুর। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, বখতিয়ার খিলজির মূল আক্রমণ দলের সৈন্য সংখ্যা হয়তো সত্যিই খুব কম ছিল — সম্ভবত ১৮ থেকে ২০ জন ঘোড়সওয়ার, যারা গোপনে নবদ্বীপে প্রবেশ করে আকস্মিক আক্রমণ চালায়।

কিন্তু এর বাইরে তার পূর্ণ বাহিনী, যা বিহার থেকে নিয়ে এসেছিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রেখেছিলেন, তাদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার এর মধ্যে ছিল বলে অনুমান করা হয়। এই বাহিনী মূলত তার অভিযান-পরবর্তী শাসন কায়েম ও নিরাপত্তা বজায় রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়।

অর্থাৎ বলা যায়, নবদ্বীপের রাজার রাজধানীর ওপর আকস্মিক ঝটিকা আক্রমণটি চালিয়েছিলেন খুবই সীমিত সংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে, যাতে স্থানীয় সেনারা সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে যায়। এরপর তার মূল বাহিনী শহরে প্রবেশ করে শাসন কায়েম করে।

কৌশল: গতি ও বিস্ময়ের ওপর নির্ভর

তাহলে কেন এত কম সৈন্য নিয়ে এমন একটি বিপজ্জনক অভিযান চালালেন বখতিয়ার? এর উত্তর নিহিত তার কৌশলে।

বখতিয়ার খিলজি জানতেন, যদি তিনি বড় সৈন্যদল নিয়ে আসেন, তাহলে নবদ্বীপের সেনরা তার গতি প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। তাই তিনি হঠাৎ, গোপনে, দ্রুতগতিতে অল্পসংখ্যক যোদ্ধা নিয়ে শহরে ঢুকে পড়েন। বলা হয়, তারা নিজেদেরকে ব্যবসায়ীর বেশে নবদ্বীপে প্রবেশ করেছিল।

যখন তারা রাজপ্রাসাদের কাছে পৌঁছায়, তখন সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত সেনদের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন তড়িঘড়ি করে পূর্বদিকে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। রাজধানী প্রায় বিনা যুদ্ধে বখতিয়ারের দখলে চলে আসে।

বিজয়ের পর কী হলো?

১২০৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে (কিছু ঐতিহাসিক বলেন ১২০৩ খ্রিস্টাব্দ) এই ঘটনা ঘটে। নবদ্বীপ দখলের পর বখতিয়ার খিলজি গৌড় (লখনৌতি) কে রাজধানী করে বাংলার শাসন শুরু করেন। পরে তিনি রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, মালদহসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা নিজের কর্তৃত্বে আনেন।

তিনি এমনকি তিব্বত অভিযানেও গিয়েছিলেন, যদিও সেই অভিযান সফল হয়নি এবং ফেরার পথে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।

ইতিহাসের আলোকে সৈন্যসংখ্যার ব্যাখ্যা

প্রচলিত ইতিহাসে যে ‘১৮ জন ঘোড়সওয়ার’-এর গল্প পাওয়া যায়, সেটি মধ্যযুগীয় ইতিহাসের একটি নায়কোচিত উপস্থাপন। প্রকৃতপক্ষে, বিজয় পরবর্তী শাসন ব্যবস্থা, জনপদ নিয়ন্ত্রণ, কর আদায় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য যে বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন, তা এই আক্রমণের পেছনে নিশ্চিতভাবেই ছিল।

আবার মুসলিম সেনাপতিদের ঝটিকা আক্রমণ (ghazwa)-এর পদ্ধতি ছিল অল্প সৈন্য নিয়ে, দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়া, শত্রুকে চমকে দিয়ে মনোবল ভেঙে ফেলা। এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি সেই কৌশলের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

বাংলার ইতিহাসে প্রভাব

বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের মাধ্যমে বাংলা প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। এর ফলে

  • বাংলা ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়,

  • বাণিজ্য ও স্থাপত্যে নতুন ধারা সূচিত হয়,

  • আরবি-ফারসি ভাষা প্রশাসনের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

এই পরিবর্তন বাংলার সংস্কৃতি ও সমাজে গভীর ছাপ ফেলে, যা আজও দৃশ্যমান।

উপসংহার

সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায়, এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলায় আসেন একটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র সৈন্যদল নিয়ে। নবদ্বীপের ওপর আকস্মিক ঝটিকা আক্রমণের জন্য তার সাথে মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ার ছিল বলে প্রচলিত ইতিহাসে বলা হয়। তবে মোট সৈন্যসংখ্যা অনুমান করা হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার, যারা পরবর্তীতে বাংলায় শাসন প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছিল।

তার এই দুঃসাহসিক অভিযান আমাদের শেখায় যে, শুধুমাত্র বিশাল বাহিনী নয়—সঠিক কৌশল, গতি এবং শত্রুকে বিস্মিত করার ক্ষমতাই ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে। এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় সেই কৌশলের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...