এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি কখন বাংলায় আসেন? এক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা
বাংলার ইতিহাসে কয়েকটি মুহূর্ত চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির আগমন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর বাংলায় প্রবেশ এবং নাবাদ্বীপ জয়ের মধ্য দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। এই ঘটনাকে অনেক ইতিহাসবিদ মধ্যযুগীয় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলা হয়ে থাকে। এই প্রবন্ধে আমরা জানবো, তিনি কখন, কীভাবে, এবং কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলায় আসেন এবং তাঁর আগমন কীভাবে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় চিত্র পাল্টে দেয়।
বখতিয়ার খিলজি কে ছিলেন?
এখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম সেনানায়ক। তিনি খিলজি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা মূলত আফগানিস্তানের গজনি ও ঘোর অঞ্চলে বসবাস করতেন। ১২শ শতকের শেষ ভাগে মুসলিম শাসকগণ যখন উত্তর ভারত জয় করছিলেন, তখন বখতিয়ার খিলজি ভাগ্য অন্বেষণে ভারতবর্ষে আসেন।
প্রথমে তিনি দিল্লি ও পরে বিহারে কিছুদিন সৈন্যদলে চাকরি করেন। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর সাহস, কৌশল এবং নেতৃত্বগুণের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। এরপর তিনি বিহারের বহু অঞ্চল জয় করে সেখানে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন।
বাংলায় আগমন: সময়কাল ও প্রেক্ষাপট
ইতিহাসবিদদের মতে, ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি প্রথম বাংলার দিকে অগ্রসর হন এবং ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নাবাদ্বীপ আক্রমণ করেন। এই সময় বাংলায় সেন রাজবংশের শাসন চলছিল এবং লক্ষ্মণ সেন ছিলেন একজন শক্তিশালী ও প্রাজ্ঞ রাজা। তবে তাঁর প্রশাসন তখন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং রাজধানী ছিল আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ কিন্তু প্রতিরক্ষায় শিথিল।
বখতিয়ার খিলজি বিহার থেকে যাত্রা করে মাত্র ১৭ জন ঘোড়সওয়ারসহ গোপনে বাংলায় প্রবেশ করেন। অত্যন্ত সাহসী ও চমকপ্রদ এই অভিযানে তিনি নাবাদ্বীপে পৌঁছে সরাসরি রাজপ্রাসাদে আক্রমণ করেন। সেই সময় রাজা লক্ষ্মণ সেন পূজারত ছিলেন এবং হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত হয়ে পালিয়ে যান পূর্বাঞ্চলে, সম্ভবত বিক্রমপুর বা বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চলের দিকে।
নাবাদ্বীপ জয়: একটি যুগান্তকারী ঘটনা
নাবাদ্বীপ জয় মুসলিম শাসনের ইতিহাসে এক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। বাংলার মত সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত রাজ্যকে এত অল্প সংখ্যক সেনাবাহিনী দিয়ে জয় করা ছিল এক নজিরবিহীন কীর্তি। এই বিজয়ের মাধ্যমে:
-
বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে,
-
সেন রাজবংশের পতনের সূত্রপাত হয়,
-
পূর্ব ভারতে ইসলামিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক ধারা প্রসারিত হতে শুরু করে।
বখতিয়ার খিলজি তখন লখনৌতি (বর্তমানে গৌড়, মালদা) কে বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন এবং নিজেকে বাংলার শাসক ঘোষণা করেন।
বিহার ও বাংলা শাসন: শিক্ষা, ধর্ম ও সমাজে প্রভাব
বখতিয়ার খিলজির শাসনকাল ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। বিহারে মুসলিম শাসন কায়েম করার সময় তিনি নালন্দা, উদয়ন্তপুর এবং বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করেন। এই আক্রমণগুলো বৌদ্ধ ধর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর ওপর বড় আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলায় তাঁর শাসনকালে ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ এবং দরগাহ গড়ে উঠতে শুরু করে। যদিও ধর্মান্তর বা জোরপূর্বক ইসলাম প্রচারের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না, তথাপি সুফি দরবেশদের মাধ্যমে ইসলাম ধীরে ধীরে বাংলার গ্রামীণ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
বখতিয়ার খিলজির মৃত্যু নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেন তিনি তিব্বতে অভিযানের পর অসুস্থ হয়ে পড়ে মারা যান (প্রায় ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে), আবার কেউ বলেন, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতিরা ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, যার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তবে বাংলায় মুসলিম শাসনের যে ভিত্তি তিনি স্থাপন করেন, তা ভবিষ্যতে ইলিয়াস শাহী, হুসাইন শাহী এবং পরবর্তীতে বঙ্গাল সুলতানদের জন্য পথ প্রশস্ত করে দেয়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সমালোচনা
বখতিয়ার খিলজির নাম ইতিহাসে গৌরব ও বিতর্ক—উভয় দিক থেকেই উচ্চারিত হয়। একদিকে তিনি বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রবেশদ্বার খুলে দেন, অন্যদিকে তাঁর নালন্দা ও বিক্রমশীলা ধ্বংসের জন্য তিনি সমালোচিত।
তবে এ কথা নিশ্চিত যে, তাঁর আগমন শুধু একটি রাজনৈতিক বিজয় ছিল না; এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিপ্লবের সূচনা। বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি পরে ইসলামী প্রভাবের সঙ্গে মিশে এক নতুন পরিচয়ে গড়ে ওঠে, যার রূপরেখা তিনি এঁকে দিয়েছিলেন।
উপসংহার
এখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বাংলায় আগমন (১২০৩-১২০৪ খ্রিস্টাব্দ) একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। তাঁর ছোট বাহিনী নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসের গতিপথ বদলে যায়। যদিও তাঁর শাসনকাল দীর্ঘ ছিল না, তবে তাঁর রেখে যাওয়া প্রভাব যুগ যুগ ধরে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় পরিবর্তনে প্রতিফলিত হয়েছে।
তাঁর আগমন কেবল একটি আক্রমণ ছিল না; এটি ছিল ইতিহাসের এক গভীর বাঁক পরিবর্তনের সূচনা।
Comments
Post a Comment