Skip to main content

#আফগানিস্তানকে কেন কফিনের দেশ বলা হয়?


আফগানিস্তানকে কেন কফিনের দেশ বলা হয়?

আফগানিস্তান—একটি ভূখণ্ড যার নাম শুনলেই যুদ্ধ, ধ্বংস, এবং অপার শোকের চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই দেশটি ছিল বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর কবরস্থান। কখনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন, আবার কখনও যুক্তরাষ্ট্র—আফগানিস্তান তাদের প্রতিটির জন্যই হয়ে উঠেছে এক রক্তাক্ত অধ্যায়, এক ‘কফিন’। এই নিবন্ধে আমরা অনুসন্ধান করব কেন আফগানিস্তানকে “কফিনের দেশ” বলা হয় এবং এই অভিধাটি কতটা সঙ্গতিপূর্ণ।

১. ভৌগোলিক এবং কৌশলগত অবস্থান: যুদ্ধের খেলা

আফগানিস্তান দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভারত, ইরান, চীন, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মাঝখানে অবস্থান করে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূকৌশলগত এলাকা হয়ে উঠেছে। এটি “গ্রেট গেম”-এর মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে পশ্চিমা ও প্রাচ্য শক্তিগুলো বারবার নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই দেশটির খাড়া পর্বত, বিশৃঙ্খল গোষ্ঠীগত সমাজ এবং প্রতিরোধী সংস্কৃতি তাদের বারবার ব্যর্থ করেছে।

২. ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিন

১৮৩৯ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত আফগানিস্তানের সঙ্গে ব্রিটিশদের তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম অ্যাঙ্গলো-আফগান যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২) ছিল সবচেয়ে অপমানজনক। ব্রিটিশ বাহিনী কাবুল দখল করলেও, বিদ্রোহের মুখে তারা পিছু হটে। ১৮৪২ সালে কাবুল থেকে কেবলমাত্র একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক উইলিয়াম ব্রায়ডেন জীবিত ফিরে আসেন। প্রায় ১৬,৫০০ সৈন্য এবং তাদের সহচর নিহত হয়। এই ঘটনা আফগানদের অদম্য প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে যায় এবং ব্রিটিশদের জন্য আফগানিস্তান হয়ে ওঠে “অপমানের কফিন”।

৩. সোভিয়েতদের পতনের সূচনা

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। তারা আফগান কমিউনিস্ট সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু ফল হয় সম্পূর্ণ বিপরীত। দশ বছরের যুদ্ধ (১৯৭৯-১৯৮৯) সোভিয়েতদের রক্তাক্ত করে তোলে। মুজাহিদিন যোদ্ধারা আমেরিকা, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সহায়তায় শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় ১৫,০০০ সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয় এবং কয়েক লক্ষ আফগান প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও মানসিক অবক্ষয়ের সূচনা ঘটায় এবং অবশেষে দেশটির পতনের পথে ঠেলে দেয়। অনেকেই বলেন, “আফগানিস্তানই ছিল সোভিয়েত সাম্রাজ্যের কফিন।”

৪. আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধ: ২০ বছরের বেদনা

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকা আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। লক্ষ্য ছিল তালেবান সরকারকে অপসারণ করা ও আল-কায়েদার মূল ঘাঁটি ধ্বংস করা। শুরুটা ছিল দ্রুত এবং সফল, কিন্তু এরপর যুদ্ধটি দীর্ঘায়িত হয়। একের পর এক সরকার পরিবর্তন, দুর্নীতি, তালেবানের প্রত্যাবর্তন, এবং বিশৃঙ্খল প্রত্যাহার—সব মিলিয়ে এই যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম ও ব্যর্থ সামরিক অভিযানে পরিণত হয়।

২০২১ সালে আমেরিকার শেষ সৈন্য প্রত্যাহারের সময় তালেবান পুনরায় ক্ষমতা দখল করে। এ যুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রের ২,৪০০+ সৈন্য মারা যায় এবং লক্ষ লক্ষ আফগান নাগরিক প্রাণ হারান বা উদ্বাস্তু হন। অনেক মার্কিন পর্যবেক্ষকই বলেন, আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল “আরেকটি ভিয়েতনাম”—একটি ব্যর্থতা, একটি কফিন।

৫. আফগান জনগণের দুঃসহ জীবন: কফিন শুধু আগ্রাসীদের জন্য নয়

“কফিনের দেশ” শুধু বাইরের শক্তিগুলোর জন্য নয়—এই শব্দবন্ধটি আফগান জনগণের জন্যও এক বাস্তবতা। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী শিক্ষার উপর নিষেধাজ্ঞা, এবং ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদ—সব মিলিয়ে আফগানদের জীবন যেন এক চলমান শোকগাঁথা। যুদ্ধের কফিনে শুধুই সৈন্যরা নয়, কবরস্থ হয়েছে লাখো সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ এবং স্বাধীনতা।

৬. ‘কফিনের দেশ’ উপাধির পেছনে প্রতিরোধ ও আত্মমর্যাদা

আফগানদের দৃঢ়তা এবং সাহসিকতাও এই ‘কফিনের দেশ’ অভিধার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। তারা কখনোই কোন আগ্রাসী শক্তিকে স্থায়ীভাবে জয়ী হতে দেয়নি। প্রতিটি আক্রমণই তাদের প্রতিরোধকে শক্তিশালী করেছে। আফগানিস্তান যেন জানিয়ে দিয়েছে—“তোমরা আমাদের দখল করতে পারো না, কারণ আমরা মরতে জানি, কিন্তু মাথা নত করতে জানি না।”

৭. ‘কফিন’ না ‘অমরত্ব’? এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি

অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা যায়, আফগানিস্তান একটি কফিন নয়, বরং এক বিশাল চেতনার ঘাঁটি—যেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর দাম্ভিকতা ভেঙে চুরমার হয়েছে। প্রতিবারই আফগানিস্তান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, নিজের রূপে ফিরে এসেছে। একে 'কফিনের দেশ' না বলে 'চির-প্রতিরোধের দেশ' বললেও ভুল হবে না।

উপসংহার: ইতিহাসের কফিন নাকি আত্মমর্যাদার বিজয়ভূমি?

আফগানিস্তানকে “কফিনের দেশ” বলা হয় কারণ এ দেশটি পরাশক্তিগুলোর জন্য বারবার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। তবে এই শব্দবন্ধ শুধুমাত্র ধ্বংস বা পরাজয়ের প্রতীক নয়। এটি একটি বার্তা—যে দেশটির মাটি সহজে বিক্রি হয় না, যে জাতির আত্মমর্যাদা দাম দিয়ে কেনা যায় না। আফগানিস্তান আমাদের শেখায় যে অস্ত্র দিয়ে ভূখণ্ড জয় করা যায়, কিন্তু মন এবং ইতিহাস জয় করা যায় না।

লেখক:
নূর আলম শেখ
ব্লগ: ইতিহাসের পাতায় ভ্রমণ
বিষয়: যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিরোধের মনস্তত্ত্ব


Comments

Popular posts from this blog

 খালিদ বিন ওয়ালিদ এ সাহাবীর জীবন বৃত্তান্ত, যুদ্ধ

খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ): ইসলামিক ইতিহাসের এক অমর বীর ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন এক নাম, যিনি তার অসাধারণ সামরিক প্রতিভা, বীরত্ব এবং নবীজীর (সা.) প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্যের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাকে “সাইফুল্লাহ” বা “আল্লাহর তরবারি” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)। শৈশব ও বংশপরিচয় খালিদ (রাঃ) ছিলেন কুরাইশ বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তার পিতা ছিলেন ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা, মক্কার এক প্রভাবশালী নেতা। খালিদের শৈশবেই তার বীরত্ব ও কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। তীর-ধনুক, তরবারি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তিতে তিনি ছিলেন নিপুণ। ইসলাম গ্রহণ প্রথমদিকে খালিদ (রাঃ) ইসলামের বিরোধী ছিলেন এবং উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তার হৃদয় পরিবর্তন হয় এবং হিজরতের ৮ম বছরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর খুব অল্প সময়েই তিনি ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী সৈনিকে পরিণত হন। যুদ্ধসমূহ ১. মুতার যুদ্ধ খালিদ (রাঃ) প্রথম যুদ্ধেই নেতৃত্ব পান যখন তিনজন শীর্ষ সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। মাত্র ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে ২...

# ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস

📝 শিরোনাম : ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: আগমন, শাসন, শোষণ ও যুদ্ধের ইতিহাস Meta Description (মেটা বিবরণ): ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন, শাসন, অর্থনৈতিক শোষণ ও বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস জানুন এক বিশ্লেষণাত্মক ব্লগ পোস্টে। 🔍 ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৬০০ সালে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের প্রকৃত শাসক। বাণিজ্যের আড়ালে তারা পরিচালনা করে রাজনৈতিক কূটনীতি, অর্থনৈতিক শোষণ, এবং একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এই ব্লগে আমরা জানব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আগমনের পটভূমি, শাসনের রূপরেখা, শোষণের কৌশল ও সেইসব যুদ্ধের কথা যা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছে। 📜 ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমন (১৬০০–১৭৫৭) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর , ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ প্রথমের চার্টারের মাধ্যমে। মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ইন্দিজের সাথে বাণিজ্য। কিন্তু ডাচদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে তারা তাদের দৃষ্টি ফেরায় ভারতবর্ষের দিকে। ১৬০৮ সালে ...

উসমানীয়া খিলাফত এবং এর রাজত্ব কাল

🕌 উসমানীয় খিলাফত: এক মহাসাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় উসমানীয় খিলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল অধ্যায় জুড়ে রয়েছে। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বিশ্ব ইতিহাসে এ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। এটি শুধু একটি সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না; বরং একটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক পরাশক্তি হিসেবে ইসলামী বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। 📜 উত্থান: বালক উসমান থেকে সাম্রাজ্যের ভিত্তি উসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে , আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) পশ্চিমাঞ্চলে উসমান গাজী নামে এক তুর্কি উপজাতি নেতার মাধ্যমে। তাঁর নামেই এই খিলাফতের নামকরণ— "উসমানীয়" । উসমান গাজী ছিলেন এক ক্ষুদ্র তুর্কি আমীর, যিনি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজের অঞ্চল বিস্তার শুরু করেন। তাঁর পুত্র ওরহান গাজী ও পরবর্তী শাসকগণ ধারাবাহিকভাবে ইউরোপ ও এশিয়াতে বিশাল এলাকা দখল করেন। ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বিজয় করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান, যা উসমানীয়দের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। 🌍 সাম্রাজ্য...