জয়ধ্বনির প্রতিধ্বনি: ভারতের রাজাদের শাসনামলে যুদ্ধের ইতিহাস
ভারত – এক প্রাচীন সভ্যতার ভূমি, যেখানে জ্ঞানের আলো ও আধ্যাত্মিকতার ধারা প্রবাহিত হয়েছে সহস্রাব্দ ধরে। তবে এই পবিত্র ভূমি বহুবার রক্তাক্ত হয়েছে যুদ্ধের উত্তাপে। হিমালয়ের শিখর থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের উপকূল, গঙ্গা-যমুনার উর্বর সমতল থেকে পশ্চিমের মরুভূমি – এই ভূখণ্ড বারবার সাক্ষী থেকেছে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও পতনের। রাজাদের শাসনকাল কেবল কূটনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাস নয়, তা যুদ্ধের ইতিহাসও, যা ভারতের রাজনৈতিক সীমারেখা ও সামাজিক কাঠামোকে নতুন আকার দিয়েছে।
প্রাচীন ভারত: মহাজনপদ থেকে মৌর্য সাম্রাজ্য
রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যে বিশাল যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকভাবে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতাব্দীতে “মহাজনপদ” যুগে ষোলোটি শক্তিশালী রাষ্ট্র একে অপরের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। এর মধ্যে মগধ সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে, বিশেষত বিম্বিসার ও অজাতশত্রু-এর আমলে।
তবে প্রকৃত সাম্রাজ্যিক উত্থান শুরু হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২২-২৯৮) এর হাতে। নন্দ বংশকে পরাজিত করে মৌর্য সাম্রাজ্য গঠন করেন তিনি। এরপর আলেকজান্ডারের উত্তরসূরি সেলেউকাস নিকেটরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন, যার পরিণতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয় এবং মৌর্য সাম্রাজ্য পশ্চিমদিকে বিস্তৃত হয়।
তার পৌত্র সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৮-২৩২) কালের অন্যতম ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ২৬১)। এই যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে অহিংসার নীতি গ্রহণ করেন, যদিও সাম্রাজ্যিক শক্তি তখনো দুর্দমনীয় ছিল।
গুপ্ত যুগ ও দক্ষিণের আঞ্চলিক শক্তি
মৌর্যদের পতনের পর উঠে আসে গুপ্ত সাম্রাজ্য (খ্রিস্টীয় ৩২০-৫৫০)। এই সময়কে ভারতের “সোনালী যুগ” বলা হলেও, এটি ছিল সামরিক অভিযানে ভরপুর। সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৭৫ খ্রিঃ) বহু রাজ্য জয় করেন, যাকে "ভারতের নেপোলিয়ন" বলা হয়। তাঁর আলাহাবাদ স্তম্ভে বিশদ যুদ্ধজয়ের বিবরণ পাওয়া যায়।
দক্ষিণ ভারতে, চালুক্য ও পল্লব রাজবংশের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ হয়। পুলকেশিন II (৬১০-৬৪২ খ্রিঃ) উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করে দক্ষিণ ভারতের সামরিক ক্ষমতার প্রমাণ রাখেন।
মধ্যযুগ: মুসলিম আক্রমণ, দিল্লি সালতানাত ও রাজপুত সংগ্রাম
১০ম শতকের শেষ দিকে মহম্মদ গজনী ভারতে একাধিক অভিযান চালান, যদিও তিনি স্থায়ী সাম্রাজ্য গঠন করেননি। এরপর আসে দিল্লি সালতানাত (১২০৬-১৫২৬), যার অধীনে আলাউদ্দিন খিলজী (১২৯৬-১৩১৬) দক্ষিণভারত দখলের জন্য বহু অভিযান চালান। তিনি মঙ্গোল আক্রমণও প্রতিহত করেন।
রাজপুত রাজারা মুসলিম আক্রমণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রতিরোধ চালান। পৃথ্বীরাজ চৌহান ও মুহাম্মদ ঘোরি-র তরাইন যুদ্ধ (১১৯১ ও ১১৯২) ছিল ইতিহাসের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।
দক্ষিণে, বিজয়নগর সাম্রাজ্য (১৩৩৬-১৬৪৬) মুসলিম সালতানাতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কৃষ্ণদেব রায় (১৫০৯-১৫২৯) বাহমানি ও অন্যান্য সুলতানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। কিন্তু তালিকোটার যুদ্ধ (১৫৬৫) বিজয়নগরকে বিপর্যস্ত করে দেয়।
মুঘল ও মারাঠা যুগ: যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়
বাবর (১৫২৬-১৫৩০) পানিপথের প্রথম যুদ্ধ-এ ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) রাজপুত, গুজরাট, বাংলা দখল করে সাম্রাজ্যকে বিশাল রূপ দেন।
ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) দীর্ঘদিন দক্ষিণভারতের মারাঠা ও বিজাপুর-গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালান। এসব যুদ্ধ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালেও অর্থনৈতিক দুর্বলতা তৈরি করে।
ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ (১৬২৭-১৬৮০) মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করে মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত্তি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ (১৭৬১) মারাঠাদের বড় ধাক্কা দিলেও, তারা উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিধর শাসকে পরিণত হয়।
ইউরোপীয় শক্তির উত্থান: উপনিবেশিক দ্বন্দ্বের সূচনা
মুঘল ও মারাঠা শক্তির পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলি, বিশেষত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বাড়াতে থাকে। হায়দার আলী ও টিপু সুলতান ইংরেজদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পরাজিত হন। অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধগুলো শেষ পর্যন্ত মারাঠা শক্তির পতন ঘটায়।
উপসংহার
ভারতের রাজাদের শাসনামলের যুদ্ধের ইতিহাস এক অমর গাথা – যেখানে রয়েছে বীরত্ব, রক্তপাত, কৌশল, বিশ্বাসঘাতকতা এবং সংস্কৃতির সংঘাত। প্রতিটি যুদ্ধ কেবল জমি দখলের লড়াই ছিল না; তা ছিল চিন্তাধারা, ধর্ম, ও সংস্কৃতির লড়াইও। এই যুদ্ধগুলো আজও ভারতের ইতিহাসে গভীর প্রভাব রেখেছে – ভাষা, সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যিক বিভাজন এবং আধুনিক ভারতের সীমানা নির্ধারণে। এই ইতিহাস কেবল অতীতের গল্প নয়, এটি আজও আমাদের পরিচয় ও ভবিষ্যতের দিশা নির্ধারণে সহায়ক।
Comments
Post a Comment