শিরোনাম: টিপু সুলতান বনাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি: প্রতিরোধ ও যুদ্ধের অজানা ইতিহাস
মেটা বর্ণনা: টিপু সুলতান ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘাতের চমকপ্রদ ইতিহাস জানুন। যুদ্ধের কারণ, পরিণতি ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে টিপুর প্রতিরোধের কথা জানুন।
ভূমিকা
"মাইসোরের বাঘ" নামে পরিচিত টিপু সুলতান ছিলেন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এবং বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ১৮শ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে তাঁর তীব্র প্রতিরোধ তাঁকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক করে তোলে।
এই ব্লগে আমরা টিপু সুলতানের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বন্দ্বের কারণ, প্রধান যুদ্ধসমূহ এবং এই মহান নেতার ঐতিহাসিক প্রভাব আলোচনা করব।
কে ছিলেন টিপু সুলতান?
টিপু সুলতান ছিলেন হায়দার আলীর পুত্র, যিনি দক্ষিণ ভারতের মাইসোর রাজ্যের শাসক ছিলেন। ১৭৫১ সালে জন্মগ্রহণ করা টিপু শৈশব থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ১৭৮২ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাইসোরের সুলতান হন।
তিনি শুধুমাত্র একজন যোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন একজন সংস্কারকও। যুদ্ধের জন্য রকেট প্রযুক্তি, কর ব্যবস্থার সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ফ্রান্স ও অটোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান
১৭০০ শতকের মধ্যভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সুযোগে কোম্পানি কূটনৈতিক চুক্তি, স্থানীয় রাজাদের মধ্যে বিভাজন এবং যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এ সময় মাইসোর ছিল তাদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধক।
সংঘাতের কারণসমূহ
টিপু সুলতান ও ব্রিটিশদের মধ্যে সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শগত নানা কারণ ছিল:
১. ভূখণ্ড সম্প্রসারণের প্রতিযোগিতা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ ভারতে তাদের প্রভাব বাড়াতে চাইত, যেখানে মাইসোর ছিল বড় বাধা। টিপুও তাঁর রাজ্য সম্প্রসারণে আগ্রহী ছিলেন।
২. বাণিজ্যিক স্বার্থে সংঘর্ষ
টিপু সুলতান ফরাসিদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন ও ব্রিটিশদের পিপার ও চন্দন কাঠের বাজারে প্রবেশ বাধা দেন, যা কোম্পানির স্বার্থে আঘাত করে।
৩. আদর্শগত প্রতিরোধ
টিপু ব্রিটিশদের ইসলাম ও ভারতীয় স্বাধিকারবোধের জন্য হুমকি মনে করতেন। তিনি অনেকবার মুসলিম শাসকদের কাছে পত্র লিখে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন।
৪. পূর্ববর্তী যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া
অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধসমূহে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও পিতার মৃত্যুর পর টিপু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।
অ্যাংলো-মাইসোর যুদ্ধসমূহ
প্রথম যুদ্ধ (১৭৬৭–১৭৬৯)
হায়দার আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। মাদ্রাজ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়।
দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৭৮০–১৭৮৪)
হায়দার আলীর মৃত্যুর পর টিপু নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মাঙ্গালোর চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
তৃতীয় যুদ্ধ (১৭৯০–১৭৯২)
ব্রিটিশরা মারাঠা ও হায়দরাবাদের নিজামের সাথে মিত্রতা করে। সেরিংগাপত্তম চুক্তিতে টিপু তাঁর অর্ধেক রাজ্য এবং দুই পুত্রকে বন্ধক দেন।
চতুর্থ যুদ্ধ (১৭৯৯)
চূড়ান্ত লড়াইয়ে টিপু সুলতান শ্রীরঙ্গপত্তমে শহীদ হন। ব্রিটিশরা মাইসোর দখল করে।
টিপু সুলতানের মিত্রতা
ব্রিটিশদের প্রতিরোধে টিপু বিভিন্ন দেশের সাথে মিত্রতা গড়ার চেষ্টা করেন:
-
ফ্রান্স: ফরাসি সেনা উপদেষ্টা মাইসোর সেনাদের প্রশিক্ষণ দেন।
-
অটোমান সাম্রাজ্য ও আফগানিস্তান: মুসলিম ঐক্যের ডাক দেন।
-
মারাঠা ও নিজাম: শত্রু হলেও পরে আলোচনার চেষ্টা করেন।
কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও ব্রিটিশ কূটনীতি তাঁর প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে।
টিপু সুলতানের উত্তরাধিকার
টিপু সুলতানের ইতিহাসচর্চায় মতবিরোধ থাকলেও তিনি এক অনন্য প্রতিরোধের প্রতীক:
-
বীর প্রতিরোধকারী: সাহস, আত্মত্যাগ ও রকেট প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য স্মরণীয়।
-
বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব: কিছু ঐতিহাসিক তাঁকে ধর্মীয় নিপীড়নের অভিযোগে সমালোচনা করেন।
-
জাতীয় নায়ক: কর্ণাটকে তাঁকে সম্মান জানানো হয় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করা হয়।
উপসংহার
টিপু সুলতান ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘাত শুধু যুদ্ধ নয়, ছিল আদর্শ, অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যের সংঘর্ষ। টিপুর মৃত্যু দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য নিশ্চিত করে। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম আজও জাতীয় চেতনার অংশ।
Comments
Post a Comment