শিরোনাম: ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ যুদ্ধের সূচনা (১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ)
মেটা বিবরণ: জানুন কীভাবে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে। এর কারণ, প্রধান ঘটনাবলি ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।
ভূমিকা
১৮৫৭ সাল ছিল ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই বছর ঘটে যাওয়া বিদ্রোহ, যাকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহি বিদ্রোহ বলা হয়, ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বড়সড় প্রতিরোধ। যদিও বিদ্রোহটি দমন করা হয়, তবে এটি সমগ্র উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটায় এবং পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করে।
পটভূমি: ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা
১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীর মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যুদ্ধ, কূটনৈতিক চুক্তি এবং ফাঁকি দিয়ে ভারতজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করে। লর্ড ডালহৌসির 'ডকট্রিন অফ ল্যাপস', অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক হস্তক্ষেপ ভারতীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
প্রাচীন প্রথা অবহেলিত হয়, কৃষকদের উপর কঠিন কর আরোপ করা হয়, এবং বহু শিল্প-হস্তশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ভারতীয় সৈনিকদের (সিপাহি) উপরেও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো।
বিদ্রোহের কারণসমূহ
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ একক কোনো ঘটনার ফল নয়, বরং ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং সামরিক ক্ষোভের সম্মিলিত বিস্ফোরণ।
১. রাজনৈতিক কারণ
-
লর্ড ডালহৌসির 'ডকট্রিন অফ ল্যাপস' অনুসারে কোনও রাজ্যের উত্তরাধিকারী না থাকলে তা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যেত।
-
ঝাঁসি, সাতারা ও আওধ-এর মত রাজ্যগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়, যা রাজপরিবার ও জনগণের ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
২. অর্থনৈতিক কারণ
-
জমিদারি ও স্থায়ী বন্দোবস্ত নীতিতে কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
-
ব্রিটিশ পণ্যের আগমনে ভারতীয় হস্তশিল্প ধ্বংস হয়ে যায়।
-
তাঁতি, মজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জীবিকা হারান।
৩. সামাজিক ও ধর্মীয় হস্তক্ষেপ
-
খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা ও ধর্মান্তরকরণ ভারতীয়দের মধ্যে ভয় ও ক্ষোভ তৈরি করে।
-
হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি ও আচার-আচরণে হস্তক্ষেপ বিদ্রোহের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪. সামরিক কারণ
-
ভারতীয় সিপাহিরা বৈষম্যমূলক বেতন ও পদোন্নতির শিকার ছিলেন।
-
এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু ও শুকরের চর্বি ব্যবহারের গুজব সিপাহিদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে, যা ছিল বিদ্রোহের তাৎক্ষণিক কারণ।
বারাকপুরের ঘটনা: বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ
মার্চ ১৮৫৭ সালে বারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডে নামক এক সিপাহি এনফিল্ড রাইফেলের বিরোধিতা করে নিজের ব্রিটিশ অফিসারদের উপর আক্রমণ করেন। তাঁকে পরে গ্রেফতার করে ফাঁসি দেওয়া হয়, কিন্তু এই ঘটনা সমগ্র ভারতের বিদ্রোহে রূপ নেয়।
মূল বিদ্রোহের সূচনা: ১০ মে ১৮৫৭
১০ মে ১৮৫৭ তারিখে মেরঠ শহরে সিপাহিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁরা তাঁদের অফিসারদের হত্যা করে, বন্দি সিপাহিদের মুক্ত করে দিল্লির দিকে মার্চ করেন এবং বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর-কে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেন।
এটি একটি সামরিক বিদ্রোহ থেকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়।
প্রধান বিদ্রোহ কেন্দ্রসমূহ
বিদ্রোহ উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহ:
১. দিল্লি
-
বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে প্রতীকী রাজধানীতে পরিণত হয়।
-
সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি পুনরুদ্ধার করে।
২. কানপুর
-
নানা সাহেব নেতৃত্বে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দেন।
-
এখানে ব্রিটিশ বেসামরিকদের হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা ব্রিটিশ প্রতিশোধকে আরও নির্মম করে তোলে।
৩. লক্ষ্ণৌ
-
বেগম হযরত মহল, আওধের রানী, তাঁর পুত্রকে নবাব ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
৪. ঝাঁসি
-
রানী লক্ষ্মীবাই ছিলেন বিদ্রোহের অন্যতম কিংবদন্তি চরিত্র।
-
১৮৫৮ সালে গ্বালিয়রে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি শহীদ হন।
৫. বিহার, গ্বালিয়র, ও বেরেলি
-
কুয়ার সিং, তাঁতিয়া টোপে, ও খান বাহাদুর খান বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
বিদ্রোহ দমন
১৮৫৮ সালের মাঝামাঝি, অতিরিক্ত সৈন্য ও প্রাদেশিক রাজাদের সহযোগিতায় ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে।
-
দিল্লি পুনর্দখল করা হয়।
-
নেতারা যেমন লক্ষ্মীবাই, টাঁটিয়া টোপে নিহত হন।
-
বাহাদুর শাহ জাফর বন্দি হন ও রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন।
বিদ্রোহের পরিণতি
১. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান
-
১৮৫৮ সালের সরকার আইন (Government of India Act) এর মাধ্যমে ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের হাতে যায়।
-
কুইন ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী হিসেবে ঘোষিত হন।
২. প্রশাসনিক ও সামরিক সংস্কার
-
সেনা বিভাগে ভারতীয় ও ব্রিটিশদের মধ্যে ভারসাম্য আনা হয়।
-
ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ কমে।
৩. জাতীয়তাবাদের উত্থান
-
বিদ্রোহ ভবিষ্যতের আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
-
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫) গঠিত হয়।
উপসংহার
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। যদিও এই বিদ্রোহ সফলভাবে ব্রিটিশদের উৎখাত করতে পারেনি, তবে এটি ভারতীয়দের মধ্যে ঐক্য, চেতনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বীজ বপন করে।
মঙ্গল পাণ্ডে, রানী লক্ষ্মীবাই, বাহাদুর শাহ জাফর, টাঁটিয়া টোপে-সহ সকল যোদ্ধাকে আমরা আজ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।
Comments
Post a Comment